ক্ষমতাচ্যুত ইমরান, এরপর কী?

এখন সময়: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ০২:১৯:৩০ পিএম

স্পন্দন ডেস্ক: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

দেশটিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। এ প্রেক্ষাপটে শনিবার রাতে দেশটির পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তাঁর বিরুদ্ধে আনা বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়।

 ভোটাভুটিতে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবটি পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট।

পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রীই তার পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তবে এভাবে অনাস্থার মাধ্যমে ইমরান খানই প্রথম তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী।

সোমবার নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হতে পারে। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এন(পিমএমএল-এন) এর প্রধান শাহবাজ শরিফই পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের নেতৃত্বে আসছেন বলে ধারনা করা হচ্ছে।

রোববার সকালে বিরোধী সমর্থকদের রাস্তায় গাড়ির জানালা দিয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা নাড়তে দেখা গেছে। রাজধানীতে ব্যাপক নিরাপত্তা সদস্যদের উপস্থিতি রয়েছে। তবে তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটার খবর পাওয়া যায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ইমরান খানের ভাগ্যনির্ধারণী এ অধিবেশন শুরু হয় শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায়। তবে অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণ পর দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। এভাবে তিন দফা মুলতবি শেষে ইফতারের পর আবার অধিবেশন শুরু হয়। তখন জানানো হয়, রাত সাড়ে ৯টায় আবার অধিবেশন বসবে।

বিরোধী দলের আইনপ্রণেতারা শুরু থেকেই অভিযোগ করেন, ইচ্ছা করেই অধিবেশন বিলম্বিত করা হচ্ছে। এ জন্য পাল্টা কৌশল ঠিক করতে বিরোধীদলীয় নেতা পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতি শাহবাজ শরিফের চেম্বারে বৈঠক করেন দলীয় সদস্যরা। স্পিকার আসাদ কায়সারের চেম্বারে গিয়ে তাঁর সঙ্গেও তাঁরা দেখা করেন। এ সময় তাঁরা স্পিকারকে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুরোধ জানান।

আর্থিক দুরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলগুলো। এ অনাস্থা প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে ৩ এপ্রিল খারিজ করে দেন জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এতে চরম রাজনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান।

এ অবস্থায় স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। বিরোধীরাও আদালতের শরণাপন্ন হন। টানা পাঁচ দিনের শুনানি শেষে গত বৃহস্পতিবার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। একই সঙ্গে শনিবার অনাস্থা প্রস্তাবের সুরাহার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ।

এদিকে ইমরান খান অভিযোগ করেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। আর এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত।

অন্যদিকে দেশটির চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে সেনাবাহিনী দৃশ্যত দূরে রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর দেশটিতে চার বার সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং তিন দশকেরও বেশি সময় পাকিস্তান সেনা শাসনের অধীনে ছিল।

৩ বছর ৭ মাস ২৩ দিনের মাথায় ক্ষমতা হারিয়ে ইসলামাবাদও ছেড়েছেন ইমরান খান।  তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। প্রশ্ন উঠেছে তিনি আগামী নির্বাচনে লড়াই করে ফের ক্ষমতায় ফিরবেন নাকি রাজনীতি থেকেই বিদায় নেবেন?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতা হারালেও ইমরান খানের দুর্ভোগ কমছে না। তাকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। সাবেক এই ক্রিকেটারের পরিকল্পনা ছিল সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেওয়া। তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। জানা গেছে, সোমবারই পাকিস্তানের নবনির্বাচিত সরকার শপথ নেবে। স্বাভাবিকভাবে তারা ক্ষমতায় এসে দ্রæত নির্বাচন দেবে না।

বরং নতুন সরকার চাইবে পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা যেন তলানিতে ঠেকে। এই লক্ষ্যে ইমরান খানের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এমনকি ইমরান খানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারে তারা। তাই পরবর্তী নির্বাচন হলেও সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে যাবে ইমরান খানের জন্য। এজন্য ভবিষ্যতে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী পদে ফেরার  সম্ভাবনাও আপাতদৃষ্টিতে কমই মনে হচ্ছে।

অবশ্য রাজনৈতিক জীবন একেবারে ছোটও নয় ইমরানের। ১৯৯২ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতির ময়দানে আসেন। দুর্নীতিবিরোধী ¯েøাগান তুলে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠা করেন তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ।

পরের বছর ১৯৯৭ সালে তিনি নির্বাচনে দুটি আসন মিয়াওয়ালি এবং লাহোর থেকে দাঁড়ালেও হেরে যান। তবে তাতে থামেননি। ২০০২ সালে মিয়াওয়ালি থেকে জয়ী হন।

প্রথমে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফকে সমর্থন দিলেও ২০০৭ সালে ৮৫ জন পার্লামেন্ট সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন ইমরান। সে বারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। গৃহবন্দি করা হয় ইমরানকে। কিছু দিন হাজতবাসও করতে হয়।

তবে রাজনৈতিক লড়াই চলতেই থাকে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের দশম নির্বাচনে তার দল দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়, আর ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের একাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষের আশা ছিল যে, ক্ষমতায় আসার আগে যেসব প্রতিশ্রæতি ইমরান খান দিয়েছিলেন সেগুলো তিনি পূরণ করবেন। পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি দূর হবে, জবাবদিহিতা আসবে, বিদেশে পাচার হওয়া দুর্নীতির অর্থ ফেরত আসবে, বৈদেশিক ঋণ কমবে, প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার হবে, ১ কোটি মানুষ চাকরি পাবে, পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ি পাবেসহ সব মিলিয়ে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে- ইমরান খানকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকে।

২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে ইমরান খানের দিক থেকে যত প্রতিশ্রæতি এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেশে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে প্রথম ভাষণেও ইমরান খান ঘোষণা করেন, যারা দেশের সম্পদ লুট করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে এই বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ ছিল না এবং বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিসেবে মনে করা হয়। মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু হওয়ার পর বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মামলাগুলো যৌক্তিক কোনো সমাপ্তি হয়নি।

ইমরান খানের সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক সংকট এবং তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেবেন। আইএমএফের কাছে যাবেন না, ঋণ হ্রাস করবেন, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনবেন।

সেখানে তার আমলেই মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, রেকর্ড পতনে পাকিস্তানি মূদ্রার মূল্য ধাক্কা খায়, যার মধ্যে অর্থমন্ত্রীও তিনবার পরিবর্তন করেন।

তবে, খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন ‘কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মত লড়াই করতে’।

মনে হচ্ছে তিনি এখন এক ‘কোনাঠাসা বাঘের মত’ শক্তিশালী বিরোধী চরিত্রেও পরিণত হতে পারেন।