আবদুল কাদের : নাব্যতার কারণে জাহাজ ডুবির ঝুঁকি সত্বেও যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া নৌবন্দরে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ আমদানিকৃত পণ্য এসেছে। দুই হাজার ৫১৯টি জাহাজে পণ্য এসেছে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন। যা থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯১ হাজার ২৪৬ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই নৌবন্দরে এক হাজার ৬১৩টি জাহাজে ৭ লাখ ৬ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন পণ্য এসেছিল। যাতে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৮৬ টাকা। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৫৮৪টি জাহাজে পণ্য এসেছে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ৩৭৫টি জাহাজে পন্য এসেছে ৫ লাখ ৯০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন পণ্য এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার ২০৫টি জাহাজে এসেছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন পণ্য।
নাব্যতা-সংকট, সরু চ্যানেলসহ নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় গেল দেড় বছরে ১৫টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
পণ্যবাহী জাহাজের মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, মূলত চার কারণে বারবার জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে। প্রথমত, নিয়মিত খনন না করায় নৌবন্দরে ভৈরব নদের নাব্যতা-সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। খননকাজ সুষম বা ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। কোথাও গভীর আবার কোথাও মোটেও খনন করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, দখলের কারণে ভৈরব নদ দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, অদক্ষ মাস্টাররা মূল চ্যানেলের বাইরে এসে নদের কিনারায় জাহাজগুলো নোঙর করেন। চতুর্থত, সময়মতো মেরামত না করায় পণ্যের অতিরিক্ত ওজনের চাপ সহ্য করতে না পেরে পুরোনো জাহাজের তলা ফেটে তা পানিতে তলিয়ে যায়।
নওয়াপাড়া নৌবন্দরের দৈর্ঘ্য মুজতখালী থেকে আফরাঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। ৯ ফেব্রুয়ারি শুভরাড়া এলাকায় ৮৫০ টন ইউরিয়া সারবোঝাই এমভি সেভেন সিজ-৪ নামের একটি কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় নওয়াপাড়া নোনা ঘাট এলাকায় ভৈরব নদের ঘাটে এমভি সাকিব বিভা-২ নামে একটি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার কয়লা ছিল।
জাহাজের মাস্টার জুয়েল হোসেন বলেন, ‘জাহাজ থেকে ইউরিয়া নামানোর সময় ভাটায় জাহাজের তলদেশের সঙ্গে মাটিতে থাকা পাথর কিংবা শক্ত কোনো বস্তুর সজোরে আঘাত লাগে। এতে তলদেশ ফেটে জোয়ারের সময় জাহাজটি ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়।’
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি সিদ্দিপাশায় গমবোঝাই এমভি ওয়েস্টার্ন-২ কার্গো জাহাজ কাত হয়ে ডুবে যায়। এ সময় জাহাজে প্রায় ৭০০ টন গম ছিল।
এ ছাড়া গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ৮২০ টন কয়লাসহ এমভি আর রাজ্জাক, ১৩ এপ্রিল ৬৮৫ টন কয়লাবোঝাই এমভি সাকিব বিভা-২, ১৫ জানুয়ারি প্রায় ৮০০ টন কয়লাবাহী এমভি পূর্বাঞ্চল-৭ ও ১৩ জানুয়ারি ৭০০ টন কয়লা নিয়ে এমভি মৌমনি-১ কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়।
জাহাজের এক শ্রমিক জানান, ভৈরব নদে আগের তুলনায় জাহাজের সংখ্যা বাড়লেও নোঙর করার জায়গা খুবই কম। পানি কম থাকায় দুর্ভোগে পড়তে হয়। নওয়াপাড়া নদীবন্দর সচল ও নিরাপদ রাখতে নিয়মিত নদী খনন ও নিরাপদ জেটি নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের।
খুলনা নৌপরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব থেকে বড় নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতির কেন্দ্র নওয়াপড়া বন্দরের এ বেহাল অবস্থা দীর্ঘদিনের। নদীর নাব্যতা কম। পানি কমতে কমতে নদী ছোট হয়ে আসছে। সঠিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং করার প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা বারবার বলেছি। তবে এর সমাধান হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নওয়াপাড়া শাখার সদস্যসচিব নিয়ামুল ইসলাম রিকো বলেন, ‘নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের নাব্যতা-সংকট প্রকট। দখলে নদ সরু হয়ে আসছে। খননকাজ সুষম বা ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। কোথাও গভীর আবার কোথাও মোটেও খনন করা হয় না। যে কারণে ঘন ঘন জাহাজ ডুবছে।’
সার ও খাদ্যশস্য আমদানিকারক আদিত্য মজুমদার বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। নিজেরাই ঘাট তৈরি করে নিচ্ছি। পণ্য আমদানি বোঝাই জাহাজের হার বাড়লেও উন্নয়ন হচ্ছে না। শুধু ট্যাক্স দিয়েই যাচ্ছি। কোনো প্রকার সুবিধা পাচ্ছি না।’ গেল অর্খবছরে দ্বিগুণ পরিমাণ পন্য এসেছে এই বন্দর থেকে।
নওয়াপাড়া সার ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, ‘ভৈরব নদকে ঘিরে নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। প্রতিবছল এখন পন্য আমদানি বাড়ছে। আমরা ঠিকমতো ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু নদীবন্দরের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এখানে ছোট জাহাজ এলেও ঘাটে ভিড়তে পারে না। এ জন্য আমরা গাইড ওয়াল নির্মাণের দাবি করেছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি।’
এ বিষয়ে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমান পণ্য এসেছে। ব্যবসায়ীদের সব ধরণের সহযোগিতা আমরা করে যাচ্ছি। ‘সব নদ-নদীতে নাব্যতা-সংকট রয়েছে। ভৈরব নদে ড্রেজিং চলছে। মূলত অদক্ষ মাস্টার-ড্রাইভার নিয়ম না মেনে জাহাজগুলো মূল চ্যানেলের বাইরে এসে নদের কিনারায় নোঙর করেন। তা ছাড়া পুরোনো জাহাজের তলদেশ নিয়মিত ডকিং বা মেরামত না করায় অতিরিক্ত পণ্যের চাপে ভাটায় এসব জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ছে।’
তবে বন্দরের উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে মাসুদ পারভেজ বলেন, নওয়াপাড়া নদী বন্দরটি নিয়ে সরকার অনেক কাজ করেছে। সামনে আমাদের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়ন হলে আরও বেশি জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে আমাদের স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপনের কাজ চলমান। এরপরও প্রতিবছর আমাদের এখানে পণ্যবাহী জাহাজের হার বেড়েছে। এতে করে আমাদের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।