একটি লেবু চারা থেকে আজ ২৮৫ রকমের গাছ শোভা পাচ্ছে

ফারহানার বাড়ির ছাদ যেন সবুজের সমারোহ

এখন সময়: মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১০:৪২:২৯ এম

মিজানুর রহমান মুন :

ফারহানা ইয়াসমিন। একজন গৃহবধূ। ছাদ কৃষি করে একবারে গ্রাম্য বধু থেকে এখন হয়ে উঠেছেন অন্য গৃহবধূদের কাছে আইডল। পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক। ঝুলিতে রয়েছে আরো ছোট বড় ১৫টি সম্মাননা। ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখতেন তা একটু একটু করে বাস্তবে রুপ লাভ করছে। গাছ-গাছালির প্রতি ভালোবাসা আর সবুজের সমারোহ কাছে টানার মোহ থেকে আজ সবুজ বিপ্লবের রাণী হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজের এক টুকরো ছাদ ফেলে না রেখে টবে সব ধরণের গাছ লাগিয়ে সবুজের সমারোহ ঘটিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। ছাদ বাগান শুধু সৌন্দর্য নয়, বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতাও আসছে। তার দেখাদেখি অনেকে এখন ছাদ বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। নিজের বাগান পরিচর্যার পাশাপাশি তিনি নারীদের গ্রুপ করে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি একজন প্রশিক্ষকের ভূমিকাও পালন করছেন।

সেই প্রথম শুরু ২০১২ সালে। প্রথমে যশোর শহরের বকচরে থাকাকালীন সাড়ে ৯শ বর্গফুটের ছাদে একটি লেবু চারা লাগান তিনি। এই লেবুচারা থেকে পরবর্তীতে ছাদ ভরে ওঠে নানাজাতের ফুল-ফল সবজিতে।

পরিধি বাড়তে থাকে ছাদ বাগানের। এরপর ২০২২ সালের দিকে বকচর থেকে চলে আসেন শহরতলীর মোবারককাটি কাজীপুর  গ্রামে। এখানে এসে ৬শতক জমি কিনে পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের একটি বাড়ি করেছেন। নিচতলা ফাঁকা রেখে দোতলা কমপ্লিট করেছেন।  এই দোতলার ছাদ ভরে উঠেছে ২৮৫টি নানা ধরণের গাছ-গাছালিতে। কি নেই তার ছাদে। ৩২ বছরের দামি বনসাই থেকে শুরু করে এভোকোডো, রামভুটান, চকোচকো, স্টেবরিসহ নানা ধরণের ফুল-ফল, সবজি এখন ছাদকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করছে। শুধু ছাদবাগান করেই তিনি বসে নেই। বাড়ির পাশে ডোবায় নানাজাতের মাছ চাষ করছেন।  বাড়ির নিচে ফাঁকা জায়গা ভরে তুলেছেন নানাজাতের সবজি ও ফল ফুলে।

যশোর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে সদরের রামনগর ইউনিয়নের মোবারককাঠি-কাজীপুর গ্রামে এখন ফারহানা ইয়াসমিনের বাড়ি। সম্প্রতি তার বাড়িতে যেতে একেবারে বেগ পেতে হয়নি। একনামে তাকে সবাই চেনে ও জানে ছাদ বাগানের বধূ হিসেবে। যশোর-খুলনা মুল সড়ক থেকে দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তা ধরে গ্রামে যেতে রাস্তার পাশেই তার বাড়ি। যেন অন্য বাড়ি থেকে তার বাড়ির দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা।

দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে ছাদের ওপর শোভা পাচ্ছে সবুজের সমারোহ। আর বাড়ির আশপাশ ভরে উঠেছে ফুল ফল মাছে। বাড়ির পিলারে সাটানো আছে সর্বোচ্চ  রাষ্ট্রীয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত ফারহানা ফ্রুটস এন্ড ফ্লাওয়ার গার্ডেন, ফারহানা মৎস্য খামার। রাতে এই পুরো বাড়ি লাল নীল সবুজ হলুদ বাতিতে আলোকজ¦ল হয়ে ওঠে। ছাদ বাগানসহ আশপাশ পাল্টে যায় চোখ ধাঁধানো আলো-আধারিতে।

কথা হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পাওয়া এই গৃহবধূ ফারহানা ইয়াসমিনের সাথে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী স্বামী আকরাম হোসেন, মেয়ে ফারজানা বৃষ্টি ও আফসানা ইয়াসমিন বন্যা আমার এই কাজে বরাবরই অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় মেয়ে বৃষ্টি একজন উদ্যোক্তা ও ছাদ বাগান করে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে বন্যা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢাকায় পড়াশুনা করছে।

ফারহানা বলেন, ছাদ বাগান শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে না । সংসারের অধিকাংশ চাহিদাও মিটছে । ছাদে বসে ঘুরে প্রশান্তিও পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকে ব্যবসাও হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে ও দুর-দূরান্ত থেকে মানুষ পছন্দমতো গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ছাদ বাগানের পাশাপাশি বাড়িতে মধু, খেজুরের গুড়, আচার, মধু মিক্স তৈরি করে বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। বাড়তি আয় যোগ হওয়ায় সংসারে সচ্ছলতাও হচ্ছে।

ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ছাদ বাগানসহ কৃষিতে সাফল্য আসায় পুরস্কারও মিলছে। বিভিন্ন কৃষি মেলা থেকে এ পর্যন্ত ১৫টি পুরষ্কার পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালের ১ মার্চ সবচেয়ে বড় পুরস্কার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেন। তিনি এ অনুষ্ঠানে পদক পাওয়ার অনুভূতিও ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, বর্ষাকালে নারীদের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করেন। ২০ জন নারীকে নিয়ে সিআইজি গ্রুপ করেছেন। এ গ্রুপের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে গ্রামে পাড়া পাড়ায় গিয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেন। এদের অনেকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। তার কথা চাকরি চাইবো না, চাকরি দিবো এই মন্ত্রে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে সাফল্য ধরা দেবে।

সফলতার পিছনে সাংবাদিকদের অবদানের কথা উল্লেখ করে ফারহানা বলেন, সাংবাদিকরা সবসময় তার কর্মকান্ড নিয়ে পজেটিভ সংবাদ প্রকাশ করেছে। ছাদবাগান ও কৃষির চিত্র দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। এজন্য আমি আজ অন্যরকম ফারহানা হয়ে উঠেছি। পেয়েছি জাতীয় পুরস্কার।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ফারহানা বলেন, আমার ছাদকৃষি থেকে ভবিষ্যতে আমি নিরাপদ এগ্রোফার্ম করতে চাই। যেখানে নিরাপদ সবজি ও নিরাপদ ফল উৎপাদন ও বিপণন করতে পারি। শহরে থেকে এতো বড় স্বপ্ন নিজে সফল করা সম্ভব না। এজন্য সরকারি ভাবে সহায়তা প্রয়োজন। যেখানে বেকার যুব ও  মহিলাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারি।

নারী স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও পুষ্টির জন্য বসত বাড়িতে সবজি উৎপাদন বিষয়ে আরো বেশি  অবহিতকরণ করতে চাই। বিষ মুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষক ও কৃষাণীদের ফ্রি প্রশিক্ষণ দিতে চাই।

আমি পরিবেশবান্ধব  উপায়ে কৃষিকাজ করি এজন্য আমার এলাকা ছাড়াও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষি কাজে উৎসাহিত করতে চাই।

তবে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে এপর্যন্ত কোন অনুদান পায়নি। অনুদান পেলে হয়তো আমার কর্মকাণ্ডের পরিধির আরো প্রসার ঘটতো। আমার প্রকল্পে বেশি করে বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম।

ফরহানার স্বামী আকরাম হোসেন বলেন, স্ত্রীর সফলতায় আমি খুশি। তার একাজে বাধা না দিয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছি। দুই মেয়েও বরাবরই মায়ের পাশে থেকেছে। ফলে সে এতদূর এগোতে পেরেছে। এখন সমাজে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।