খাইরুল ইসলাম নিরব, ঝিনাইদহ : ‘আরব দেশে মানব বেশে, এলো একজনা’ যার পরশে লোহা ঘসলে রে হয়ে যায় সোনা’ ‘জিন্দা দেহে মুরদা বসন, থাকতে কেন পরনা, মন তুমি মরার ভাব জান না, মরার আগে না মরিলে পরে কিছুই হবে না/আমি মরে দেখেছি, মরার বসন পরেছি, কয়েকদিন বেঁচে আছি, তোরা দেখবি যদি আয় পাগলা কানাই বলতেছি। এমন শত শত গানের ¯্রষ্ঠা মরমী লোক কবি পাগলাকানাইয়ের জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।
শনিবার সকালে জেলা পরিষদের সচিব সেলিম রেজা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজিবুল ইসলাম খান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাড. আব্দুর রশীদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিনের উপস্থিতিতে কবির মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। আর অনুষ্ঠান শেষ হবে ১৬ মার্চ। সদর উপজেলার বেড়বাড়ী গ্রামের পাগলাকানাই সমাধিস্থলে উৎসবের শেষ দিনেও চলবে পাগলা কানাইয়ের লেখা অনেক সংগীত।
পাগলা কানাই স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ কর্তৃক আয়োজিত ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এই জন্মজয়ন্তী উৎসবের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পাগলা কানাই স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আব্দুর রশীদ।
গতকালের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও অতিথিবৃন্দের সাথে ৬ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের উপস্থিত সকলে ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, চিত্রাঙ্কন, বই পাঠ, সংগীতানুষ্ঠান ও লোকনৃত্য প্রতিযোগিতা, পাগলাকানাই রচিত গানের প্রতিযোগিতা, পাগলাকানাইয়ের জীবনীর উপর উপস্থিত বক্তৃতা, কৌতুক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন ।
প্রসঙ্গত. পাগলাকানাই একজন লোককবি ছিলেন। তিনি ঝিনাইদহের সন্নিকটে লেবুতলা (মতান্তরে বেড়বাড়ী) গ্রামে ১৮১০ সালের ৯ মার্চ (বাংলা ১২২৬ সালের ২৫ ফালগুন) মাসে তিনি জম্মগ্রহণ করেন। কুড়ন-মোমেনার তিন সন্তানের মধ্যে পাগলাকানাই ও উজ্জল দু’পুত্র এবং স্বরনারী (মতান্তরে সরনারী) এক কন্যা। ছোটবেলা থেকে পাগলাকানাই দুরন্ত প্রকৃতির, পাগলাটে স্বভাবের এবং আধ্যাত্মিক প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এ খেয়ালিপনার জন্যে শৈশবে ¯েœহবশত লোকে তাঁর নামের সাথে ‘পাগলা’ অভিধাটি যুক্ত করে। তাঁর কর্মকীর্তির সাথে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রন্থিত হয়েছে। বাল্যকালে পিতৃহারা হওয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন ভবঘুরে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে কানাইয়ের লেখাপড়া শেখা সম্ভব হয়নি। পিতার মৃত্যুর পর পাগলা কানাই লেবুতলা থেকে এসে কালীগঞ্জের ভাটপাড়া গ্রামে কিছুকাল অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে হরিণাকুন্ডুর বলরামপুর ভরম মন্ডলের বাড়ি কিছুদিন রাখাল হিসেবে কাজ করার পর ভগ্নী স্বরনারীর শ্বশুরালয় বেড়বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ বেড়বাড়ী গ্রামই প্রকৃত পক্ষে কানাইয়ের কীর্তিধারিণী বলে পরিচিত। বোনের বাড়িতে তাঁর কাজ ছিল গরু চরানো। তিনি গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারীগান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গীত মুগ্ধ হয়ে শুনত। এভাবে ধুয়োজারীতে তাঁর হাতে খড়ি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর কোন সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও তৎকালীন আউল-বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণীজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগত সম্পর্কে কবি আত্মার আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাঁকে প্রখর আধ্যাত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাঁর গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবীর প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়। পাগলা কানাই নিরক্ষর হলেও তাঁর স্মৃতি ও মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন। এ পর্যন্ত পাগলা কানাই রচিত গানের মধ্য প্রায় ১৫ শ সংগৃহিত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড, মাযহারুল ইসলাম, আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য প্রমুখ মনীষীগণ পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন। এ বাউল কবি ১৮৮৯ সালের ১২ জুলাই ইহলোক ত্যাগ করেন।