উৎপল বিশ্বাস, নেহালপুর : ‘আমি তো সুস্থ মানুষ, তারপরও হীরা মেম্বার বলল, টাকা দিলে একটা কার্ড করে দেবে। কিন্তু যে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেবে তা জানতাম না। বলছিলেন শিউলি রানী দে, নেহালপুর ইউনিয়নের একজন গৃহবধূ। তার চোখে নেই অসহায়ত্ব, কিন্তু তার নাম এখন সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের তালিকায়। তাকে দেখানো হয়েছে, শারীরিক প্রতিবন্ধী। শিউলি রানীর কার্ড করে দিতে সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সদস্য এবং যুব মহিলা লীগ নেত্রী নিগার সুলতানা হীরা তার কাছ থেকে নিয়েছেন ৫ হাজার টাকা। শিউলি রানীর মতো এমন অভিযোগ ওই ইউনিয়নের, সাজেদা বেগম, কহিনুর বেগম, খলিলুর রহমান, শাহিনারা খাতুন পান্না, খালেক মোল্যা ও তহমিনা বেগমের। সবারই নাম এখন প্রতিবন্ধীর খাতায়। কিন্তু এদের কেউই প্রতিবন্ধী নন। এ ঘটনাটি ঘটেছে মণিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নে। ২০২৪ সালে ওই ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৮১ জনের, যার অর্ধেকই প্রতিবন্ধী নন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের বাদ দিয়ে ক্ষমতার দাপটে সম্পূর্ণ সুস্থ ও সক্ষম ব্যক্তিদের নামে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নিগার সুলতানা হীরা। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।২০২৪ সালে নতুন প্রতিবন্ধী তালিকা তৈরির জন্য উপজেলার প্রতি ইউনিয়ন থেকে আবেদন সংগ্রহ করে উপজেলা সমাজসেবা অফিস। এতে নেহালপুর ইউনিয়ন থেকে আবেদন পড়ে প্রায় সাড়ে তিন’শ। মণিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের দাবি, সবগুলো আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে নতুন তালিকায় নেহালপুরের ৮১ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদেরকে সুবর্ণ নাগরিক কার্ড দেয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নতুন তালিকায় যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের অর্ধেক প্রতিবন্ধী নন। এ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে কর্মরত আসাদুল হক চঞ্চল, ইউপি সদস্য শাহিদুল ইসলাম, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য লাকি খাতুন ও আলেয়া বেগম। তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, এই তালিকা তৈরিতে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সদস্য এবং যুব মহিলা লীগ নেত্রী নিগার সুলতানা হীরা ক্ষমতার দাপটে ও টাকার লোভে এই ভূয়া কার্ড তৈরি করে দিয়েছেন। শিউলি রানী দে’র মতো ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাজেদা বেগমও একই অভিযোগ করেন। তিনি জানান, হিরা মেম্বার আমার কাছ থেকে জরিপ ও অনলাইন খরচের কথা বলে ৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। বলেছিলেন, কার্ড করে দিবেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিবেন তা জানতাম না। সাজেদা বেগম সাংবাদিকদের সামনে সবকিছু স্বীকার করে বলেন, আমিতো প্রতিবন্ধী না। একইভাবে, তালিকায় রয়েছে কহিনুর বেগম ও খলিলুর রহমানের নাম। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। তালিকায় রয়েছে শাহিনারা খাতুন পান্নার নাম। তার স্বামী আবুল কালাম আজাদ বলেন, পান্না কোন প্রতিবন্ধী না। ৩ হাজার টাকা নিয়ে হীরা মেম্বর পান্নাকে কার্ড করে দিয়েছেন। এমনকি তালিকার ৩৯ ও ৪০ নম্বর সিরিয়ালের খালেক মোল্যা ও তহমিনা বেগম সবাই সুস্থ ও স্বামী-স্ত্রী। ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি এম খলিলুর রহমান বলেন, শুনেছি যুব মহিলা লীগ নেত্রী সাবেক মেম্বার নিগার সুলতানা হীরা টাকার বিনিময়ে কিছু লোকের ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড তৈরি করে দিয়েছে। আমি দাবি করবো সমাজসেবা অফিস ডেন পুনরায় তদন্ত করে তারপর প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করে। নেহালপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত প্যানেল চেয়ারম্যান শওকত সরদার বলেন, সাবেক মহিলা মেম্বার হীরা সমাজসেবা অফিস ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিসের লোকদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। আমি তাকে বহুবার নিষেধ করেছি, কিন্তু তিনি শোনেননি। জানতে চাইলে সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সদস্য এবং যুব মহিলা লীগ নেত্রী নিগার সুলতানা হীরা কার্ড তৈরিতে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, শিউলি রানী দে, সাজেদা বেগমসহ বেশ কয়েকজনের কাগজপত্র আমি সমাজসেবা অফিসে জমা দিয়েছিলাম। পরে যাচাই-বাছাই করে সমাজসেবা অফিস তাদের কার্ড দিয়েছে, এতে আমার করার কি আছে। মণিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, এ অফিসে আমি সদ্য যোগদান করেছি। তবে শুনেছি ওই ইউনিয়নের প্রায় চারশ’ আবেদনের মধ্যে জরিপ করে ৮১ জনকে বাছাই করা হয়েছে। এই তালিকায় অনুমোদন দিয়েছেন প্যানেল চেয়ারম্যান শওকত সরদার। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী নন এমন কেউ কেউ যদি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তবে অভিযোগ পেলে বাছাই করে তাদের বাদ দেয়া যাবে।