সকিনা খাতুনের জীবন সংগ্রাম

এখন সময়: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল , ২০২৪, ০৭:২৪:০৪ পিএম

ফখরে আলম: আমার বাবার পরামর্শে আকিজ উদ্দিন সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। গ্রাম থেকে ডাব, নারকেল কিনে তিনি খুলনায় নিয়ে বিক্রি করতেন। কিছু ডাব, নারকেল ঈশ্বরদী পাকশী পাঠাতেন। বেজেরডাঙা রেলস্টেশন থেকে ডাব বুক করতেন। তিনি লবণের ব্যবসাও করেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে লবণ বিক্রি করেছেন। বিভিন্ন মেলায় অস্থায়ী দোকানও দিতেন। এসব ব্যবসা করে তিনি খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। এক পর্যায়ে আমার বাবার পরামর্শে বেজেরডাঙা রেলস্টেশনের পাশে তিনি একটি মুদি দোকান দেন। অল্প সময়ের মধ্যে দোকানটি জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু একদিন রাতে আগুনে দোকানটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাইয়ে চাপা পড়ে আমাদের সব স্বপ্ন। আগুন লাগার সময় তিনি দোকানেই ছিলেন। পরনের লুঙি ছাড়া তার সব কিছুই পুড়ে যায়। জামা পুড়ে যাওয়ার কারণে তিনি খালি গায়ে থেকেছেন। আমি ৪টাকা দিয়ে গাছপাতা রঙের একটি শার্ট তাকে কিনে দিই। পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় ফের দোকান নির্মাণ করেন। মুদি ব্যবসার পাশাপাশি শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডালের ব্যবসা। এর মধ্যে আকিজ উদ্দিন কয়েক দফা আমার বাবাকে বলেন, ‘আমি ভিটায় ঘর তুলব। সকিনাকে নিয়ে আমাদের ভিটায় থাকব।’ বাবা কোনভাবেই তার কথায় রাজি নন। তার ইচ্ছা সারাজীবন আমি বাবার কাছেই থাকি। একদিন বাবা তার কাছে দোকানের লাভ লোকসানের হিসাব চান। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি আর দোকানে বসবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। অন্যদিকে তাদের ভিটায় খড়ের ‘বাইশো’ (বাঁশের ঘর) একটি ঘর তুলে আমাকে সেখানে নিয়ে যান। এতে আমার বাবা খুব কষ্ট পান। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। এমনকি আমার সৎ ভাইকে হুঁশিয়ার করে দেন, ‘আকিজ উদ্দিনের বাড়ির সীমানায় পা রাখলে পা ভেঙে ফেলা হবে’। এ কারণে আমার বাবা ও সৎ ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আকিজ উদ্দিন নতুন করে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেন। তিনি সিকে বাঁকে করে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সুপারি কিনে আনেন। আমি সারারাত জেগে সেই সুপারি ছিলেছি। তিনি কলকাতায় সুপারির চালন পাঠিয়েছেন। এতে বেশ লাভ হয়। লাভ হলে গুণ গুণ করে গান গেয়েছেন। আমাদের গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামে বিভিন্ন ধরনের গানের আসর বসত। তিনি রাত জেগে ওই সব আসরের গান শুনে ভোররাতে বাড়ি ফিরতেন। কিছু বলতে গেলে রেগে যেতেন। আমাকে বকাঝকা করতেন। রাত জেগে গান শোনার পাশাপাশি তিনি মাঝে মধ্যে উধাও হয়ে যেতেন।

১৯৫২ সালের দিকে আকিজ উদ্দিন তার বন্ধুর বাবা ‘বিধু’ বিড়ির মালিক বিধু ভূষণের পরামর্শে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। বিড়ির ব্যবসার সূত্র ধরে তিনি যশোরের নাভারণে ঘর ভাড়া নেন। ভারত থেকে আসা ‘ব্লাকের (চোরাচালন) পাতা কিনে তিনি বিড়ি তৈরি করতেন। এ জন্যে পুলিশ কাস্টমস ঝামেলা করত। একবার ঝিকরগাছা থানার পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর ব্লাকের পাতা দিয়ে বিড়ি বানাবেন না। তিনি নাভারণের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোজাহার বিশ্বাসের সহায়তায় চোরাই পথে আসা ভারতীয় পাতা বাদ দিয়ে কাগজের বিড়ি তৈরির ছোট্ট একটি কারখানা গড়ে তোলেন। এটিই নাভারণের আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি নামে দেশব্যাপী এখন পরিচিত। ছোট ছোট ঘরে তৈরি করে এই কারখানাটি আজিক উদ্দিন রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে দাঁড় করান। অল্প সময়ের মধ্যে ‘আকিজ বিড়ি’ হাট বাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিড়ি ব্যবসার নেশায় তিনি ঘোর হয়ে যান। পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করে যে, বিড়িই তার জীবন। তিনি বিড়ির পেছনে ছুটতে থাকেন। আমার খোঁজ খবর নেয়ার সময় নেই। ১০/১৫ দিন পরপর তিনি নাভারণ থেকে মধ্যডাঙায় আসতেন। এর মধ্যে আমি পোয়াতি হই। আমার মনে অনেক আনন্দ। এই আনন্দ প্রথম সন্তানের মা হওয়ার আনন্দ। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কেউ না থাকায় আমার আনন্দের সংবাদ কাউকে জানাতে পারিনি। পোয়াতি হলেও এক গ্লাস দুধ একটি ডিম ভাগ্যে জোটেনি। কচুঘেচু শাকসবজি খেয়েছি। ইচ্ছা হলেও মাছ মাংস খেতে পারিনি। অভাব ছিল। তিনিও নিয়মিত আমার খরচের টাকা দিতেন না। এই অবস্থার মধ্যে ১৯৫৪ সালে আমার প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। বাড়ির পাশের মাওলানা প্রথা অনুযায়ী আজান দেন। তিনি নবজাতকের নাম রাখেন মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিনেরও কপাল পোড়া। তাকেও আমি ঠিকমত দুধ খাওয়াতে পারিনি। বুকের দুধই খাওয়াতাম। কিন্তু অপুষ্টিজনিত কারণে আমার বুকের দুধ ফুরিয়ে যায়। তখন অনেক কষ্টে গরুর দুধ সংগ্রহ করেছি। সেই দুধ চিনি ছাড়াই গামলায় করে মহিউদ্দিনকে খাইয়েছি। মধ্যডাঙা গ্রামের আলো হাওয়ায় আমি মহিউদ্দিনকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। মহিউদ্দিনের জন্মের ১৪ বছরের মধ্যে আমি আরও ৪টি সন্তানের মা হই। এরা হচ্ছে মোমিনউদ্দিন, সাফিনা, আফিল ও শাহিনা। আমি কোন সন্তানকেই মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খাওয়াতে পারেনি। কিনে দিতে পারিনি একটার বেশি দুটো জামা।

সন্ধ্যা নামলে মধ্যডাঙা গ্রামে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। জোনাকি পোকার আলো, আকাশের তারা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। শোনা যায়, হুতোম পেঁচা আর শিয়ালের ডাক। ভয়ে গা ছমছম করে। আমি ভয়কে তাড়িয়ে দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে সাহস করে একা একাই শিশু মহিউদ্দিনকে নিয়ে ‘বাইশো’ ঘরে রাত কাটিয়েছি। কয়েকবার চোর সিঁদ কেটে আমার শেষ সম্বল চুরি করে নিয়ে গেছে। আকিজ উদ্দিন সাত দিন, পনের দিন পরপর নাভারণ থেকে মধ্যডাঙায় আসেন। কিছু খরচের টাকা দিয়ে এক রাত থেকে ফের ব্যবসার কাজে নাভারণে চলে যায়। তিনি আমাকে বলেন, ‘তুই মধ্যডাঙায় থাক। মহিউদ্দিনকে মানুষ কর। আমার অবস্থা ভালো হলে ঘর ভাড়া করে আমি তোকে নাভারণে নিয়ে যাব।’ আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি, ‘তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি ঘরবাড়ি সামলাব। মহিউদ্দিনকেও দেখে রাখব। তুমি ব্যবসায় মন দাও। উন্নতি কর। আয় রোজগার কর।’ মহিউদ্দিনের যখন ৩ বছর বয়স তখন আমার দ্বিতীয় পুত্র সন্তান মোমিন জন্মগ্রহণ করে। আমি একইভাবে দুধ, ফেন, আটা গোলা খাইয়ে দুই ভাইকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। দুই ভাইকে দুই পাশে রেখে মাঝখানে শুয়ে প্রায় সারারাত জেগে থেকেছি। ভয় হয়েছে যদি শিয়ালে  মহিউদ্দিন, মোমিনকে টেনে নিয়ে যায়। হাতনেয় (বারান্দা) মোমিনকে বেদে পাটিতে শুইয়ে পাশে মহিউদ্দিনকে বসিয়ে রেখে আমি খড়ি সংগ্রহ করেতে গিয়েছি। গাছের মরা ডাল, পাতা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি। তাই দিয়ে ভাত তরকারি রান্না করেছি। সাত বছর বয়সে আমি মহিউদ্দিনকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করি। বর্ষাকালে হাঁটু সমান হাবড়ে (কাদায়) আমি মহিউদ্দিনকে কোলে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদেরকে অনুরোধ করে বলেছি, ‘মহিউদ্দিনের বাবা গ্রামে থাকে না। সে লেখাপড়ার খোঁজ খবর নিতে পারে না। তোমরা দয়া করে মহিউদ্দিনের খোঁজ খবর নিবা। তাকে ভালো করে পড়াবা’। আমি মহিউদ্দিনকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য স্কুলের শিক্ষক কেশবলালকে ঠিক করি। তিনি বাড়ি এসে মহিউদ্দিনকে পড়াতেন। কেশবলাল মাস্টার পরবর্তীতে মোমিনকেও পড়িয়েছেন। পাশাপাশি আমি সন্তানদের আরবি পড়া শিখিয়েছি। ছেলেবেলায় তারা কোরআনি শরীফ পাঠ করতে শিখেছে। মহিউদ্দিন নম্র, ভদ্র ছিল। সে আমার সব কথা শুনত। গ্রামের দোকান থেকে তেল, নুন কিনে নিয়ে আসত। আমি তাকে বলতাম, ‘দোকানে যাবা আর আসবা। দোকানে বসে আড্ডা দিবা না। কারো সঙ্গে কথা বলবা না। তোমার সঙ্গে যারা লেখাপড়া করে তাদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে মিশবা না।’ গ্রামের স্কুলে পড়ার সয় মহিউদ্দিন ফুলতলার হাটে যেয়ে বাজার করে আনত।

মহিউদ্দিনের যখন ৭ বছর বয়স তখন আকিজ উদ্দিন নাভারণে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় আমি মনে খুব ব্যথা পাই। মহিউদ্দিন, মোমিনের অগোচরে আমি কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। কিন্তু বিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে কোনো ঝগড়াঝাটি করিনি।

মহিউদ্দিনের যখন ৮/৯ বছর বয়স তখন আমার কোল খালি করে আকিজ উদ্দিন তাকে নাভারণে নিয়ে যান। তিনি আমাকে বলেন, ‘মহিউদ্দিন নাভারণে আমার সঙ্গে থাকবে। ওখানেই লেখাপড়া করবে। ওর নতুন মা ওকে আদার যতœ করে লেখাপড়া শিখাবে।’ মহিউদ্দিন মানুষ হবে। লেখাপড়া শিখবে। এ কারণে আমি বাধা দেইনি। তবে হাউমাউ করে কেঁদেছি। মহিউদ্দিনকে নাভারণে নিয়ে ওর বাবা ওকে ক্লাস টুতে ভর্তি করে দেন। বেশ কিছুদিন পরে মহিউদ্দিন মধ্যডাঙায় আসে। দেখি, আমার ঘ্যানা (রোগা) ছেলে মোটা হয়ে গেছে। আমি খুশিতে মহিউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরি। সেকি! মশা কামড় দিয়ে মহিউদ্দিনকে ফুলিয়ে দিয়েছে। তার শরীর বিষের মত কাল হয়ে গেছে। পরে আমি জানতে পেরেছি, মশারি ছাড়া মহিউদ্দিনকে শোয়ানো হয়েছে। পাত কুয়া থেকে পানি তোলানো হয়েছে। এমনকি বটি দিয়ে তরকারিও কোটানো হয়েছে। এসব জেনে আমি মহিউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে বলেছি, ‘বাইচে থাকতি তোরে আর নাভারণে যাতি দেব না।’ মহিউদ্দিনকে নিয়ে তার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, ‘মানুষের বাড়ি ধান ভানব। ধান সিদ্ধা শুকনো করে দেব। মহিউদ্দিনের ভাত কাপড় আমি দেব। লেখাপড়ার খরচও দেব। তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি আর কোন দিন মহিউদ্দিনকে নাভারণে নিতে পারবে না।’ আমি মহিউদ্দিন আর মোমিনকে দুই কোলে নিয়ে চুমুয় চুময় গাল ভরিয়ে দিয়েছি। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়েছে। কিন্তু দুই ছেলেকে তা বুঝতে দিইনি।

আমার মুখে একটি ফোঁড়া হয়েছিল। এই ফোঁড়ার যন্ত্রণায় আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি। আমার কান্নাকাটি আর চিৎকারে শিশু মোমিন প্রতিবেশী অনিলের সঙ্গে অনেক রাতে পাশের গ্রামে যেয়ে মংলা ঠাকুরের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেয়। আমি এক দাগ এক দাগ করে সেই ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু সাময়িকভাবে ব্যথা কমলেও ফের ফোঁড়ার যন্ত্রণায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি তোকমা ভিজিয়ে যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এক পর্যায়ে আমার মনে হয়, ফোঁড়া আমাকে মেরে ফেলবে। আমার কষ্ট দেখে মহিউদ্দিন, মোমিনও কেঁদেছে। আমি বাঁচার জন্য ফুলতলায় ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আমাকে ওষুধ না দিয়ে খুলনায় যাওয়ার কথা বলেন। অনেক কষ্টে ১০০ টাকা জোগাড় করে আমি প্রতিবেশী আলী হোসেনের সঙ্গে খুলনার বড় ডাক্তার পাশি সার্জনের কাছে যাই। তিনি ফোঁড়া কেটে পুঁজ বের করে দেন। এ জন্য ফি দাবি করেন ১৫০ টাকা। কিন্তু আমার কাছে তো এই টাকা নেই। আমি ১০০ টাকা দিই। বাকি ৫০ টাকা না দিয়ে পাশি ডাক্তারের চেম্বার‘ থেকে পালিয়ে চলে আসি। খুলনা থেকে বাসে উঠি। কন্ডাক্টর ভাড়া চায়। কিন্তু ভাড়ার টাকা কোথায় পাব ? দেব দেব বলি। বাস ফুলতলায় আসলে আমাদের গ্রামের ইমানী সরদার বাসে ওঠেন। আমি তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাস ভাড়া দিই। বাড়ি এসে বড় ছেলে মহিউদ্দিনকে সব খুলে বলেছি। এ কথাও বলেছি, ‘বাবা ডাক্তারের খুব দাম। তুমি লেখাপড়া কর। যেভাবেই হোক তোমাকে ডাক্তার হতে হবে।’ ফোাঁ অপারেশনের পর আকিজ উদ্দিন বাড়ি এলে তাকেও আমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা খুলে বলি। তিনি আমার কথা শুনে আনমনা হয়ে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তুইও ডাক্তারের ফি দিতে না পেরে পালিয়ে আসলি। একটা ছেলেকে যে কোনো ভাবেই হোক ডাক্তার বানাতে হবে। জীবনে বেঁচে থাকলে টাকা পয়সা হলে আমি গরিব মানুষের জন্য একটা হাসপাতাল করব।’

একদিন দেখি, মহিউদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে বাড়ি আসছে। কি হয়েছে বাবা ? কে তোকে মেরেছে ? পড়া পারিসনি ? মাস্টার বেত দিয়ে পিটিয়েছে ? মহিউদ্দিন কাঁদতেই থাকে। সে কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না। শুধু কাঁদে ঢোক গেলে আর বিরতি নিয়ে বলে ‘কলম, কলম’। পরে আমি বুঝতে পারি, প্রতিবেশী তাহেরের সঙ্গে নতুন কলম নিয়ে মহিউদ্দিনের ঝগড়া হয়েছে। মহিউদ্দিনের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে তাহের। তাহের নতুন কলম নিয়ে স্কুলে গেলে মহিউদ্দিন সেই কলম দিয়ে লিখতে চায়। তাহের কলম কেড়ে নিয়ে বলে, ‘তোর মাকে বল, আমার মতন কলম কিনে দিতে।’ আমি এই কথা শুনে এক হাতে দা নিয়ে আর এক হাতে মহিউদ্দিনের হাত ধরে ছুটতে থাকি। বাঁশ বাগানে যেয়ে কুঞ্চি কেটে তিন চারটি কলম তৈরি করি। মহিউদ্দিনকে বলি, ‘এই নে বাপ কঞ্চির কলমে লেখ। আমি বেঁচে থাকতে তোর কলমে কালি ফুরাবে না।’ কুঞ্চির কলম হাতে পেয়ে মহিউদ্দিন খুশিতে নেচে ওঠে। তার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। সে কলম হাতে ছুট দিয়ে বলতে থাকে, ‘তাহের তোর কলমের আমি ভুকি না। আমার মা কুঞ্চির কলম বানাই দিয়েছে। আমি কুঞ্চির কলমেই লেখব। তোর কলম ছোব না।

আমাদের গ্রামে খুব পানির কষ্ট ছিল। আমি প্রতিবেশী হাসেম আলী শেখের পুকুর থেকে কলসে করে পানি এনে রান্নার কাজে ব্যবহার করতাম। তবে প্রায় এক কিলোমিটার দূর জুড়োকোর্ট ঈদগাহ্ ময়দানের টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি নিয়ে আসতাম। বর্ষাকালে হাঁটু সমান কাদা ভেঙে খাবার পানি আনতে যেয়ে অনেকদিন আমি কলস নিয়ে পড়ে গিয়েছি। মাজায় ব্যথা পেয়েছি। তারপরও প্রতিদিনই আমি বাচ্চাদের জন্য ঐ কল থেকে খাবার পানি নিয়ে এসেছি। পানি আনার সময় একদিন মহিউদ্দিনের সঙ্গে আমার পথে দেখা হয়। মহিউদ্দিন আমার কাছ থেকে কলস কেড়ে নিয়ে মাথায় করে কলস ভর্তি পানি বাড়ি নিয়ে এসেছে। সে আমাকে বারবার বলেছে, ‘মা কল থেকে আমিই পানি নিয়ে আসব। তোমার আর পানি আনতে হবে না।’ কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। আমি তাকে বলেছি, ‘সোনা তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া কর। তোমাকে পানি আনতে হবে না। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক পানি আমিই নিয়ে আসব।’ কিন্তু বর্ষাকালে ৮/১০ বছর বয়সে আমার বালক ছেলে মহিউদ্দিন অনেকদিন কল থেকে পানি এনে দিয়ে আমার কষ্ট দূর করেছে। চলবে-

( প্রয়াত ফখরে আলমের ‘মা সকিনা’ গ্রন্থ থেকে নেয়া)