চৌগাছায় বাল্য বিয়ের দায়ে জেলে যাওয়া হতদরিদ্র চার পরিবারে চলছে হাহাকার !

এখন সময়: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১২:৫২:৫৪ এম

চৌগাছা প্রতিনিধি: ‘বৃদ্ধ বাবা-মা মিলে পরিবারে ৭ জন সদস্য। ১ ছেলে ২ মেয়ে। সবাই স্কুলে যায়। আমার মাঠে কোনো জমি নেই। অন্যের জায়গায় কোনো রকম একটি ঝুপড়িতে বাস করি। একদিন ভ্যান না চালালে সেদিন মুখে খাবার উঠেনা। আমার বড় মেয়ে গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তার স্কুলের কাগজে বাস্তব বয়সের চেয়ে কম হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার পথে বেশ কয়েকবার এলাকার বখাটেরা তাকে উত্যক্ত করেছে। এ বিষয়ে হেডস্যারকে কয়েকবার বলেছি। এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজনকেও বলেছি। কাজ হয়নি। রাস্তায় ঝামেলার ভয়ে মেয়ে যখন স্কুলে যেতে পারছিল না, তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা গরিব, একটা ভালো ঘরের ছেলে পাইছি বলে বিয়ে দিতে রাজি হই। এখন বাড়িতে পুলিশ এসে ৯ মাসের জেল ও জরিমানা করেছে’। ১ আগষ্ট সরেজমিনে গেলে কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক হতভাগা মেয়ের ভূমিহীন ভ্যানচালক বাবা আব্দুস সালাম।

যশোরের চৌগাছায় সম্প্রতি বাল্যবিয়ের দায়ে চারটি পরিবারের সদস্যদের জেল জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদের মধ্যে একটি বিবাহ সম্পন্ন হয় অন্যটি তিনটি বিয়ের আয়োজন চলছিল। বাল্যবিবাহের আয়োজন ও বিবাহ দেয়ার অপরাধে এসব পরিবারের অভিভাবককে বিভিন্ন মেয়াদে জেল জরিমানার শাস্তি দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সরেজমিনে এসব পরিবারের গুলোর অবস্থা জানতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এক করুণ চিত্র।

ভূমিহীন ভ্যানচালক পিতা আরো বলেন, যে ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছে সেই ছেলের মামা আজিজুল ইসলামকে ৯ মাসের জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। আজিজুল ইসলামও একজন ভ্যান চালক। তার পরিবারেও ৫/৬ জন সদস্য। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি জেল খাটছে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে তার পরিবারের সদস্যরা। বরের মামা আজিজুল ইসলাম ঝিনাইদহ জেলার সদর থানার খড়িখালি গ্রামের বাসিন্দা।

বাল্য বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া পাতিবিলা গ্রামের স্কুল ছাত্রীর সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ দাদা ৬ মাসের জেল জরিমানার শাস্তি ভোগ করছেন।

পাতিবিলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর সংসারে একমাত্র উপর্জনক্ষম ছেলেকে জেলে পাঠিয়ে দিশেহারা তারা। বৃদ্ধা বাড়ির বাইরে একটি বাঁশ বাগানের নিচে আলম সাধুর (স্থানীয় ভটভটি) উপরে বসে রয়েছেন। এ সময় তার ছেলের বৌ ও প্রতিবেশীরা জানান, বৃদ্ধার তিন ছেলে। ছোট ছেলের ভ্যানের চাকায় চলে সংসার। আর যে ছেলের মেয়েকে বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে জেল খাটছেন। বড় ছেলে আলম সাধু চালিয়ে (ভটভটি) দিন আনা দিন খাওয়া উপর্জন করে। মেজো ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।

প্রতিবেশীরা জানান, বৃদ্ধার নিজের কোনো ঘর নেই। অন্যের ঘরে বসবাস করে পুতনিকে (ছেলের মেয়েকে) লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। একদিকে অভাবের সংসার অন্যদিকে পাত্র পক্ষের আগ্রহ। এ কারণে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল বলে জানায় মেয়ের দাদী। মেয়ের দাদী আরো বলেন, ‘আমরা কাজীর কাছে গিয়ে বললে কাজী বিয়ে পড়াতে রাজি হয়নি। ছেলে পক্ষের সাথে কথা চলছিল এখন কি করা যাবে।  আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম  এখন আর বিয়ে দেবনা। এ সময় প্রশাসনের লোকজন এসে পড়ে। আমরা স্যারদের সত্যি কথাগুলা বলেছিলাম। তার পরেও স্যারেরা কথা শুনিনি। ধরে নিয়ে চলে যায়’। বর্তমানে অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে দিন কাটছে বৃদ্ধা দাদীর।

এছাড়া উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামের দশম শ্রেণির মাদ্রাসা ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন করার অপরাধে তার নানাকেও ৯ মাসের জেল জরিমানার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। অসচ্ছল জামাইয়ের অভাবের সংসার ঠিকমত তিনবেলা খাবার জোগাড় হয়না। এজন্য নাতনীকে নিজের কাছে রেখেছিল। এই পরিবারেরও বৃদ্ধ নানা একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তিকে জেল রেখে পরিবারের সদস্যদের দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে অ্যাড: সিরাজুল ইসলাম সাগর বলেন, চারটি পরিবার সমাজের সবচেয়ে নিম্ন আয়ের পরিবার। এদের তিনটি পরিবার অপরাধ করতে যাচ্ছিল অপরাধ এখনো সংঘঠিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে শাস্তি আরো  কম হওয়া দরকার ছিল।

তিনি আরো বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ আইনের একটি ‘ক্লজে বলা আছে, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর,  তবে বাবা-মা ইচ্ছে করলে পারিপার্শ্বিক কারণে ১৬ বছর বয়স হলেই মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবেন’। অন্য একটি ধারায় বলা হয়েছে বিবাহ সম্পন্ন না হলে মুচলেকা বা বন্ড প্রদান করে শর্তানুযায়ী নিজ এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধে আগ্রহী হলে তাকে শাস্তি  হতে অব্যাহতি প্রদান করা যাবে।

অ্যাড. সাগর আরো জানান, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭র ধারা-১৯ এ বলা হয়েছে মূলত এটি একটি বিশেষ বিধান।  এতে বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হবে না।

উল্লেখ্য. ২৯ জুলাই রাতে উপজেলার পাতিবিলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে দশম শ্রেণির স্কুল ছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করেন। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মেয়ের দাদাকে একশত টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের জেল দেন। জরিমানা অনাদায়ে আরো পনের দিনের জেল খাটতে হয় তাকে। একই দিন রাতে হাকিমপুর ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে বিয়ে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয় অ্যাসিল্যান্ড গুঞ্জন বিশ্বাস। কিন্তু এ ঘটনায় বরের মামাকে ৯ মাসের জেল দেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট গুঞ্জন বিশ্বাস।

পরেরদিন ৩০ জুলাই দুপুরে উপজেলার সুকপুকুরিয়া ইউনিয়নের আন্দুলিয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে দশম শ্রেণির মাদরাসা ছাত্রীর বিয়ে বন্ধ করে কনের নানাকে ৯ মাসের জেল ও একশ টাকা জরিমানা করেন। একই দিন মাড়ুয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে একটি বিয়ে বন্ধ করে মেয়ের বোন জামাইকে ৯ মাসের জেল ও একশ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট গুঞ্জন বিশ্বাস। বিষয়টি নিয়ে সারা উপজেলা ব্যাপী আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।