Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিম বাতিল চায় কার স্বার্থে?

এখন সময়: শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি , ২০২৫, ০৫:৩৮:৪৩ পিএম

ড. মোঃ মুনিবুর রহমান : এ বছর মার্চ মাসে ঘোষিত প্রত্যয় পেনশন স্কিম ০১ জুলাই ২০২৪ খ্রি. তারিখ থেকে বিশ্বিবদ্যালয়সহ আরও কিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নতুন যোগদানকৃত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কার্যকর হওয়ার কথা। ফলে, এখন যারা এ পেনশন স্কিম বাতিলের জন্য আন্দোলন করছেন, তাঁরা সবাই ০১ জুলাই ২০২৪ খ্রি. তারিখের অনেক পূর্বেই চাকরিতে যোগদান করেছেন এবং এ কারণে তাঁরা প্রত্যয় পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত নন। প্রত্যয় পেনশন স্কিম দ্বারা তাঁদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাহলে তাঁরা কার স্বার্থে এ পেনশন স্কিম বাতিলের আন্দোলন করছেন? প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহল উদ্দীপক। প্রশ্নটির উত্তর এক বাক্যে দেওয়া যায়, তবে তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এক বাক্যে উত্তর হল: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিলের আন্দোলন করছেন দেশ ও সাধারণ জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে। কিন্তু, কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জানা দরকার, এ পেনশন স্কিম চালু হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের কী সমস্যা? এ স্কিম চালুর ফলে ০১ জুলাই ২০২৪ খ্রি. থেকে পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ে যোগদানকৃত শিক্ষকগণ সরকারি চাকরিজীবীদের ন্যায় জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে অবসরকালে যে এককালীন আনুতোষিক পেয়ে থাকেন, সেটা আর পাবেন না। অনেকেই এই টাকাটা দিয়ে বৃদ্ধ বয়সের আশ্রয়স্থল হিসেবে একটা বাড়ি কিনে থাকেন বা জটিল রোগ-ব্যাধির চিকিৎসায় ব্যয় করেন। তাঁরা ছুটি নগদায়ন সুবিধাও পাবেন না। মাসিক পেনশন যেটা আজীবন সরকার দিয়ে থাকে, সেটা তাঁদেরকে অ-চাকরিজীবীদের ন্যায় নিজের পকেটের পয়সায় ক্রয় করতে হবে যা আবার পেনশনভোগী মারা গেলে তার মনোনীত নমিনীর ক্ষেত্রে পঁচাত্তর বছর বয়সের পর বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ,ঐ বয়সের পর মানুষ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকমণ্ডলী চাকরি করেন ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত, কিন্তু প্রত্যয় পেনশন স্কিমে একজন পেনশন প্রাপ্য হবেন ৬০ বছর বয়সে। ফলে, শিক্ষকদের চাকরির বয়স পাঁচ বছর হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ, পেনশন আর চাকরি একসাথে চলতে পারে না। এ পেনশন স্কিম চালু হলে ভবিষ্যতে যোগ্য ও মেধাবীরা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় যোগ দিতে উৎসাহিত হবেন না। এখন যেসব শিক্ষক উচ্চশিক্ষা গ্রহণার্থে বিদেশে আছেন, তারা সেখানে থিতু হওয়ার কথা ভাবছেন। যেসব শিক্ষকের বয়স কম, তাঁরা বিসিএস বা অন্য চাকরিতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে, এ পেনশন স্কিম চালু হওয়ার আগেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যেকোন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণ হল যোগ্য শিক্ষক। প্রত্যয় পেনশন স্কিম যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবে। যাঁরা আগে থেকে এ পেশায় আছেন, তাদেরকে এ পেশায় থাকতে নিরুৎসাহিত করছে। ফলে, যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের অভাবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানে ব্যাপক পতন ঘটবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রত্যয় স্কিম চালুর ব্যাপারে অনেকের ওকালতি দেখে মনে হয়, তাদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানে ধ্বংস হলে কোন সমস্যা নেই। কারণ, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না, তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে পারবেন। যারা বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে চান না, তারা বিদেশে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প খরচে যারা পড়ালেখা করেন, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানে ব্যাপক পতন ঘটার পর বেসরকারি বা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত শিক্ষার ব্যয় বহনের সামর্থ্য কি তাঁদের আছে? অধিকাংশেরই নেই। ফলে, দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা স্বল্প খরচে উন্নত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন। উচ্চশিক্ষার সুযোগ তখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে চলে যাবে। কিন্তু, দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা উন্নত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। দেশের বিভিন্ন সরকারি-সেরকারি খাতে যারা আজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখছেন, তাঁরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। ফলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী বিতাড়নের পেনশন নীতিমালা প্রণয়নের প্রেক্ষিতে আগামীতে মেধাবী ও যোগ্যরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর শিক্ষকতায় আসতে চাইবেন না। তখন উন্নত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন দেশের দরিদ্র,নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যারা বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। এ পেনশন স্কিম দেশের দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে; দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করবে। কারণ, তাঁরাই দেশের প্রাণ। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশকে ভালবাসি।দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে; আমাদের উন্নয়নের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়বে। আমরা শিক্ষক সমাজ সেটা চাই না। আমাদের বিশ্বাস, দেশবাসীও সেটা চান না। দেশবাসী যদি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যয় পেনশন স্কিমের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতেন, তাহলে তাঁরাও আজ শিক্ষকদের সাথে আন্দোলনে শামিল হতেন। যার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা, ভবিষ্যতে সে যোগ্যতা বলে অন্য পেশায় চলে যাবে। কিন্তু, উচ্চশিক্ষার জন্য সাধারণ জনগণ কি পারবেন তাঁদের ছেলেমেয়েকে অন্যদেশে পাঠাতে? কার্যত, এ পেনশন স্কিমের চূড়ান্ত শিকার হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণ। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ প্রয়োজন হয়। ১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে তখন ১৪ ডিসেম্বর তারিখে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় যাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ পরিচালনার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা না পান। আজ জাতির পিতার কন্যা যেন দেশ পরিচালনার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা না পান, তারই একটি নীল নকশা এই প্রত্যয় পেনশন স্কিম। তাই এ পেনশন স্কিম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পরিপন্থী। গত ১৩ মার্চ তারিখে প্রত্যয় পেনশন স্কিম ঘোষিত হলেও শিক্ষকমণ্ডলী ৩০ জুন পর্যন্ত একটি পরীক্ষাও বন্ধ করেননি। তাঁরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে এ পেনশন স্কিম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাস পর্যন্ত একটি ক্লাসও বর্জন করেননি। তারা জুন মাসে পরীক্ষাকে আওতামুক্ত রেখে অল্প কয়েকদিন আংশিক কর্মবিরতি পালন করেছেন। কিন্তু,অর্থমন্ত্রণালয় কোন কথায় ন্যূনতম কর্ণপাত করেনি। পহেলা জুলাই এটা কার্যকর হওয়ার তারিখ। ফলে,দেশ ও সাধারণ জণগণের স্বার্থে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাওয়া ছাড়া শিক্ষকদের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। এ প্রত্যয় পেনশন স্কিম শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নয়; দেশ ও সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে। আবারও বলতে চাই, প্রত্যয় পেনশন স্কিম আন্দোলনরত শিক্ষকদের স্বার্থহানি করছে না। এটা অদূর ভবিষ্যতে সর্বনাশ করবে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরকে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিষয়টি জনদরদী প্রধানমন্ত্রীর নিকটে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হলে তিনি সাধারণ জনগণের সন্তানদের জন্য উন্নত উচ্চশিক্ষার সুযোগ বহাল রাখার স্বার্থে আত্মঘাতী প্রত্যয় পেনশন স্কিমটি বাতিলের নির্দেশ দিবেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Ad for sale 100 x 870 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
Ad for sale 225 x 270 Position (4)
Position (4)