Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

৫ আগস্টের পর রামিম-তাশরিকদের আরেক ‘যুদ্ধ’

এখন সময়: মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই , ২০২৫, ০৬:৪৬:০৫ এম

আহসান কবীর, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক>

 রামিম যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে দেশের লাখো তরুণের মতো রাস্তায় নেমেছিলেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে তাদের বিজয়ও হয়। কিন্তু এরপর রামিমরা শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সরাসরি ‘হাসিনা খেদাও’ আন্দোলনের মতো না, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত আর শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ‘মানবিক যুদ্ধ’। ঘটনার প্রায় এক বছর পরও রামিম ও তার বন্ধুদের সেই যুদ্ধ শেষ হয়নি। প্রতিদিনই তাদের কোনো না কোনো আহত সহযোদ্ধার ডাকে সাড়া দিতে হয়।

৫ আগস্টের বিজয়ের পরপরই বিকেল নাগাদ যশোরে ঘটে যায় অনাকাঙ্খিত কিন্তু হৃদয়বিদারক এক ঘটনা। একদল তরুণ ভাংচুর শেষে আগুন দেয় শহরের চিত্রা সিনেমার মোড়ে অবস্থিত ১৭ তলাবিশিষ্ট পাঁচ তারকা হোটেল জাবিরে। এই ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩ জনই গণঅভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত ছিলেন অথবা উদ্ধারকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেখানে আহতদের কেউ কেউ আজও সুস্থ হতে পারেননি। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যশোরের যেসব তরুণ গুলিবিদ্ধ বা অন্য কোনোভাবে হতাহত হয়েছিলেন, রামিমরা তাদের বা তাদের পরিবারেরও নিবেদিতপ্রাণ সেবক।

কথা হয় মো. মেজবাউর রহমান রামিমের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল থেকে যখন যশোর জেনারেল হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি আর আহতদের গোঙানিতে, তখন আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারিনি। বন্ধুরা মিলে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তখনকার জেলা সমন্বয়ক রাশেদ খান এবং অন্যতম নেতা মারুফ হাসান সুকর্ণের নির্দেশনা মতো আমরা স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ শুরু করি। দুই-একদিনের মধ্যে আমাদের ৯-১০ জনকে নিয়ে একটি টিম গড়ে দেন নেতারা। এরও পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি হলে সেখানে ছয়টি সেল গঠন করা হয়। এর মধ্যেএকটি ছিল স্বাস্থ্য সেল। এই সেলের সম্পাদক করা হয় আমাকে। সেই যে ৫ আগস্ট শুরু করেছি, আজও কাজ চলছে অবিরাম।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, স্বাস্থ্য সেলে বেশ জনবল থাকলেও মূলত চারজন ছিলেন ফ্রন্টলাইনার। এরা হলেন, মেজবাউর রহমান রামিম, শোয়াইব হোসাইন, তাশরিক মোস্তফা এবং হুসাইন আহমেদ অয়ন। এই তরুণেরা মারুফ হাসান সুকর্ণ, তাসকিন আহমেদ তাজিন, এনএস সজীব, ইমনসহ অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে অকাতরে সহযোগিতা পেয়েছেন স্বীকার করে বলেন, অনেকের অবদান ছাড়া ভালো কোনো কাজ এগিয়ে নেওয়া দুরূহ।

স্বাস্থ্য সেলের অন্যতম সক্রিয় সদস্য যশোর সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী তাশরিক মোস্তফা বলছিলেন, ‘হতাহতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি, কাজ করার ক্ষেত্র ব্যাপক। প্রথমেই আমরা চেষ্টা করি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী করে তুলতে। অক্সিজেন, খাবার, পরিচ্ছন্নতা, অস্থায়ী কর্মীদের স্বার্থ প্রভৃতি বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে দিনের পর দিন কাজ করতে হয়েছে।’

‘জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যখন হতাহতদের বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয় তখনও আমরা শুরু থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ছাত্র প্রতিনিধির সমন্বয়ে যে টিম বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল, আমরা সেই টিমে অংশ নিই নিজেদের জনবল ভাগ করে,’ বলছিলেন আরেক যোদ্ধা তাশরিক।

এমএম কলেজের রসায়ন বিভাগের ছাত্র হুসাইন আহমেদ অয়নের ভাষ্য, ‘বাড়ি বাড়ি ভিজিট করে আমরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছি, তা সরকার, ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদদের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। আমরা দেখেছি, আন্দোলনে অংশ না নিয়েও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীর নাম কীভাবে শহীদের তালিকায় ওঠানোর চেষ্টা হয়েছে। আবার আন্দোলনে আহত হওয়া অনেক ব্যক্তি যোগাযোগের অভাবে তালিকার বাইরে ছিলেন। আমরা দিন-রাত খেটে চেষ্টা করেছি তাদের খুঁজে বের করে তালিকাভুক্ত করতে।’

রাজধানীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন যশোরের তরুণ ইমন কবির। আবার যশোরে জাবির হোটেলে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে মই ভেঙে গুরুতর আহত হন আব্দুল হাকিম আপন। এই দুইজনই নিম্নআয়ের পরিবারের সন্তান। তাদের চিকিৎসা থেকে শুরু করে অন্যান্য সহায়তায় কী কী ভূমিকা রেখেছিলেন, সলজ্জভাবে তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তরুণদের এই দল। তাদের কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসারত আপনের মা লাবনী বেগমের ভাষ্যে। তিনি বলেন, ‘রামিম, অনন্যাসহ অন্য ছাত্র প্রতিনিধিরা তাদের জন্য যা করেছেন, তা কখনও ভুলবো না। ওরা আমার নিজের সন্তানের চেয়ে কম না।’

কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের সদ্য পদত্যাগী আহ্বায়ক রাশেদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেলের তরুণরা অসাধারণ কাজ করেছেন, এখনও করে চলেছেন। এমন কোনো দিন নেই যেদিন ওদের কাছে হতাহতদের পরিবার থেকে কয়েকটি ফোনকল আসে না। ওরা সাড়াও দেয় দ্রুততার সঙ্গে। এই তরুণদের কাজে আমরা গর্বিত।’

এই প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসা সহায়তা, প্রকৃত আহতদের শনাক্ত করা প্রভৃতি কাজে এই তরুণেরা অসামান্য কাজ করেছে। তাদের কাজের কিছু সমালোচনাও হয়তো হয়েছে। মনে রাখতে হবে, যে কাজ করে, তারই সমালোচনা হয়। তাদের কাজে কিছু ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে। আমাদের উচিৎ গোটা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখা।’ -পিআইডি ফিচার

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক আমার দেশ, যশোর অফিস।

 

Ad for sale 100 x 870 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
Ad for sale 225 x 270 Position (4)
Position (4)