চৌগাছা প্রতিনিধি: যশোর জেলায় ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস আহরণের উপযোগী গাছের সংখ্যা তিন লাখ সাত হাজার ১৩০টি। গাছ থেকে তিন কোটি ৭১ লাখ তিন হাজার লিটার রস ও দুই হাজার ৭৪২ মেট্ট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে যশোরের জিআই পণ্য খেজুর গুড়ের রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাটার (গাছ পরিষ্কার ও রস সংগ্রহের উপযোগী করা) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। রোববার বেলা ১২টার দিকে চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের হায়াতপুর গ্রামে খেজুর গাছ তোলা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনুর আক্তার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী তাসমিন জাহান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হুসাইন প্রমুখ।
# জিআই পণ্য যশোরের খেজুর গুড়:
২০২২ সালে চৌগাছার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমান যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইরুফা সুলতানার উদ্যোগে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণে খেজুরগুড়ের মেলা, গাছিদের প্রশিক্ষণ, গাছি সমাবেশ, গাছিদের সমবায় সমিতি গঠন, খেজুর গাছ রোপণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই বছর যশোরের বিখ্যাত খেজুর গুড়কে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির আবেদন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খেজুরগুড়কে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেয় সরকার। খেজুর গুড় জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
# শতকোটি টাকার বাজার ধরতে ব্যস্ত গাছিরা:
যশোরের প্রায় ছয় হাজার গাছি খেজুর গাছের রস থেকে গুড় পাটালি উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে খেজুর গাছ তোলা (রস সংগ্রহের জন্য পরিস্কার) কাজ শুরু হয়েছে। অনেকেই খেজুর গাছ রস সংগ্রহের উপযোগী করে ফেলেন। যশোরের খেজুর গুড় বাংলাদেশর ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এই শিল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে খেজুর গুড়ের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। শত কোটি টাকার খেজুর গুড়ের বাজার রয়েছে। খেজুর গাছ সংরক্ষণ, রোপণ, গাছিদের প্রশিক্ষণ, প্রণোদনাসহ নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ ও জেলা, উপজেলা প্রশাসন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, যশোর জেলায় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস আহরণের উপযোগী গাছের সংখ্যা তিন লাখ সাত হাজার ১৩০টি। গাছ থেকে তিন কোটি ৭১ লাখ তিন হাজার লিটার রস ও দুই হাজার ৭৪২ মেট্ট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজার দর অনুযায়ী প্রতি লিটার রসের দাম ৩৫ টাকা ও গুড়ের কেজি ৩৪০ টাকা। সেই হিসেবে রস ও গুড়ের বাজার দর ৯৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। রস গুড় হাত বদলের সঙ্গে বাজার আরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। গাছ তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রামের গাছি আবদুল কুদ্দুস বলেন, দাদা হবিবর মণ্ডল খেজুর গাছের রস থেকে গুড় পাটালি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহী করতেন। দাদার সঙ্গে বাবাও যুক্ত ছিলেন। এখন দাদা বেঁচে নেই। সময়ের পরিক্রমায় বাবার পেশায় আমিও যুক্ত হয়েছি। বাবা আর আমি এবার তিনশ’ খেজুর গাছের রস থেকে গুড় পাটালি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। গত বছর ভাল দাম পেয়েছি। এবারও আশা করছি ভাল দাম পাবো। আমাদের মান সম্মত গুড়, পাটালির সুনাম আছে। মান ধরে রেখে ভোক্তার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবো।’
চৌগাছার পিতম্বরপুর গ্রামের গাছি মিজানুর রহমান (৭০) বলেন, সবাই গাছ তুলতে (রস সংগ্রহের উপযোগী) করতে পারে না। আমি প্রায় ৫০ বছর ধরে এই কাজ করি। প্রতিটি গাছ তুলতে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত নিই। এখন বয়স হয়েছে, এজন্য বেশি কাজ করতে পারি না। গাছ তোলার পর চাঁচ ( আবার পরিস্কার) করা হবে। এরপর নলি বসানো হয়। তারপর থেকে রস সংগ্রহ শুরু হবে।’
বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের গাছি জসিম উদ্দিন জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে আমাদের খেজুর রস ও গুড় তৈরির কাজ হয়ে আসছে। এবারও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
গাছিরা জানান, কার্তিক মাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই খেজুর গাছ ছেঁটে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। কারণ শীত মৌসুমে এ অঞ্চলের কৃষকদের অন্যতম আয়ের উৎস এটি। শীতে খেজুরের রস গ্রামীণ জনপদে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। শীতের আমেজ পায় পূর্ণতা। শীত বাড়ার সঙ্গে বাড়ে রসের মিষ্টতাও। এ জনপদে শীতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দিনের শুরুতে খেজুরের রস, সন্ধ্যায় রস ও গুড়-পাটালি। পিঠা ও পায়েস তৈরিতে আবহমানকাল থেকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খেজুরের গুড় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার কারিগরদের দানা পাটালি তৈরির সুনাম রয়েছে। পাটালি ও ঝোলা গুড় তৈরি ছাড়াও চাষিরা শীতের ভোরে ফেরি করে কাঁচা রস বিক্রি করেন। কাঁচা রস প্রতি মাটির ভাড় ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দানা গুড় ৩৫০-৪০০ টাকা, আর পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।
খেজুর গুড় বিক্রির অনলাইন প্লাটফর্ম কেনারহাটের উদ্যোক্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমাদের কাছে ভোক্তার চাহিদা ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজি গুড় পাটালি। সরবরাহ করতে পেরেছিলাম দুই হাজার কেজি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, শীত কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী গুড় পাটালি সরবরাহ করতে পারিনি। এ বছরের গুড় পাটালির জন্য ইতোমধ্যে অর্ডার আসতে শুরু করেছে।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, খেজুর গুড় জনপ্রিয় খাবার। খেজুর গুড়ে বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরি হয়। মিষ্টি তৈরিতেও খেজুর গুড় ব্যবহার হচ্ছে। খেজুর গুড়ের যেমন ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও রয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে নিরাপদ খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ, প্রশিক্ষণও উঠান বৈঠকে উদ্বুদ্ধ করছি। আশা করছি নিরাপদ রস, গুড় উৎপাদন হবে। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন।