বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন

তেল-চিনি-ডালসহ আমদানি নির্ভর পণ্যের মজুদ জরুরি

এখন সময়: বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল , ২০২৪, ০৮:৫৮:৩৫ এম

 

 স্পন্দন ডেস্ক: মহামারি করোনা ভাইরাস, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গত চার বছর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, চাল ও গমসহ নিত্য খাদ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা কিছুতেই কাটছে না। প্রথমে মহামারি করোনায় ভোগান্তি শুরু। করোনার প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ। এর সঙ্গে জলবায়ুর প্রভাব তো সর্বদা লেগেইে আছে। এসব ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমনকি শিগগিরই এর পরিবর্তন দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা খাদ্য নিরাপত্তার বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে যায়নি।

এদিকে নতুন করে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি আগামীতে আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে আমদানিনির্ভর গম, চিনি, তেল ও ডালসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো এখনই বেশি বেশি আমদানি করে মজুদ বাড়ানোর কথা বলছেন দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ব্যাংকার ও খাত সংশ্লিষ্টরা। না হলে শিগগিরই পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রয়োজন হলে আগাম সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে একই সঙ্গে তা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ সালের দিকে বিশ্বে যখন খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়, তখন বর্ধিত মূল্য দিয়েও খাদ্য কিনতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশেরও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারের অবস্থা ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বার্থে ও জরুরি অবস্থায় দেশে দেশে শুল্ক প্রত্যাহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নজির রয়েছে। অতীতে চিনির দাম বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানি পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের নজির রয়েছে।  বর্তমান সময়ে বিশ্বের কয়েকটি সংস্থার হুঁশিয়ার অনুযায়ী আবারো এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে আগামী দিনে সঙ্কট মোকাবিলায় দারুণ সহায়ক হবে।  শুধু বাংলাদেশ নয়, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা পুরো বিশ্বেই এখন একটি সঙ্কটপূর্ণ ইস্যু। বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন সঙ্কট চলছে। কোভিড, জলবায়ু পরিবর্তন ও যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি খাতকে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা তথ্য বলছে, নিকট-ভবিষ্যতে এ খাদ্যশস্যের অভাব আরো বেশি মানুষের জীবনকে বিঘিœত করতে পারে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) নতুন করে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসঙ্কটের আগাম সতর্কতা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনেও বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কটের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এরই মধ্যে ভয়াবহ পর্যায়ে চলে এসেছে। ইউক্রেনের রপ্তানি যুদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে পুরো বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি হতে পারে। জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড বলেছে, চলতি বছর অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং বিশ্ববাণিজ্য হ্রাস পাবে। আঙ্কটাড প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বমন্দা শুরু হলে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্যসঙ্কটে পড়বে। এফএও’র জরিপে দেখা যায়, এশিয়ার নয়টি দেশ বড় রকমের খাদ্যসঙ্কটের মধ্যে আছে। এ নয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ করে ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সূচক ফাও প্রাইস ইনডেক্স। জাতিসংঘের অন্যতম এই অঙ্গসংস্থা ফাও’র সূচক বলছে, চলতি বছর এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ। এই সূচকের বরাত দিয়ে গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছে, গত মার্চে সূচকের অবস্থান ছিল ১২৬ দশমিক পাঁচ পয়েন্ট, তারপর এপ্রিলের গোটা মাসজুড়ে সূচকের অবস্থান ছিল ১২৭ দশমিক দুই এবং তার আশপাশে। শতকরা হিসেবে সূচকের উল্লম্ফন হার ২০ শতাংশ। ফাও’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত এপ্রিলে সিরিয়েল, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার এবং ভোজ্যতেলের দাম প্রায় স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েছে ডাল, চিনি, মাংস এবং চালের দাম।

আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যের মধ্যে চিনির দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। বর্তমানে বাজারে কেজিপ্রতি চিনির দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত থেকেছে। ফলে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশে চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকদের সংগঠন সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর দেশে চিনির মোট চাহিদা ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টন চিনি আসত রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা থেকে। দেশি মিলগুলোর উৎপাদন কমতে কমতে এখন ৩০ হাজার টনে নেমেছে। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় সরকার টিসিবির মাধ্যমেও কিছু চিনি আমদানি করে। অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ছয় থেকে সাত শতাংশ চিনির জোগান আসে সরকারিভাবে। বাকি চিনির পুরোটাই সরবরাহ করে দেশের বেসরকারি চিনিকলগুলো। তবে চিনির কাঁচামাল আমদানিতে তাদের যে কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা শুধু নয়, একেবারে প্রত্যাহার দাবি জানান তারা। বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা না গেলে আগামী চিনির দামে ডাবল সেঞ্চুরি (২০০ টাকা) পার হয়ে যাবে।

জানা গেছে, গত বছর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই সময়ে চিনির কাঁচামাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। কিন্তু চিনির পুরনো শুল্কহারে ফেরত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। যে কারণে বর্তমানে চিনির দাম অনেক ঊর্ধ্বমুখী। তাছাড়া গ্রীষ্ম মৌসুমে বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি এ বছর রাষ্ট্রীয় চিনিকলে উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়ার কারণেও চিনির বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

ফাও প্রাইস ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে চিনির দাম বেড়েছে গড়ে ১৭ দশমিক ছয় শতাংশ। মাত্র এক মাসের মধ্যে চিনির দামের এই পরিমাণ উল্লম্ফন ২০১১ সালের পর আর দেখা যায়নি। চালের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। গত এক মাসে বিশ্ববাজারে চালের দাম শতকরা কত বেড়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে সামনের দিনগুলোতে এই দাম আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, আবহাওয়াগত কারণে বিশ্বের দুই বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীন ও ভারতে চলতি মৌসুমে চালের উৎপাদন বেশ খানিকটা কমেছে।

তবে আশার কথা হলো আমাদের দেশে বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ কারণে চালের দামে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে, মার্চ থেকে এপ্রিল এক মাসে মাংসের দাম বিশ্বে বেড়েছে এক দশমিক তিন শতাংশ। ফাও’র মূল শাখার শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো তোরেরো রয়টার্সকে বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারটি উদ্বেগজনক। কারণ বিশ্বের যেসব অঞ্চলে ভাতপ্রধান খাদ্য চালের দাম বৃদ্ধি পেলে সেখানে বিকল্প হিসেবে আটা-ময়দার ব্যবহার বাড়বে। ফলে, চালের বাজার অস্থির হলে গম-ভুট্টার বাজারেও তার প্রভাব পড়বে। দেশে মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ গম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। রাশিয়া, ইউক্রেন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব গম আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বৈশ্বিক মন্দাভাব ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে গত ১০ বছরের মধ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের স্বল্পতার কারণে শিল্পোৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় অনেক কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের কারণে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, এলএনজি ও জ্বালানি তেল, সার ইত্যাদি আমদানি করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে সাহস পাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, ২০০৯ সালেও দেখা দিয়েছিল বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট। কিন্তু সঙ্কট মোকাবিলায় সিদ্ধহস্ত প্রধানমন্ত্রী কৃষি, এসএমই, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ওপর বিশেষ নজর দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে বাংলাদেশের মানুষ ওই বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের আঁচই পায়নি। এবারো ২০২০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত পদক্ষেপে আর্থিক সঙ্কট হলেও তীব্রতর হয়নি। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে বিশ্ব খাদ্যসঙ্কট নিয়ে যে আগাম সতর্কবাণী পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এখনই উপযুক্ত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সূত্রমতে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির আওতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে চিনি, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুরসহ কিছু পণ্য আমদানি করা হয়। তাছাড়া ব্রাজিল থেকে গম, চিনি, মাংস এবং নানা ধরনের শুকনো ফল ও মসলাও আমদানি হয়। বাংলাদেশের পামতেল আমদানিতে বড় উৎস ইন্দোনেশিয়া। মূলত চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ার কারণে প্রতিবছরই আবশ্যিক খাদ্যশস্যের একটি অংশ আমদানি করতে হয়।  এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, খাদ্যসঙ্কট নিয়ে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো বার্তা দিচ্ছে। এখন আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। তবে এটা যেহেতু দীর্ঘ প্রক্রিয়া তবে সাময়িক সঙ্কট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য যেভাবেই হোক পর্যাপ্ত চাল, চিনি তেল, ডাল আমদানি করতে হবে। নতুবা সঙ্কট আরো বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, উচ্চমাত্রায় সক্রিয় একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৩৩৩ গ্রাম চাল, ৩৯ গ্রাম আটা, ৫০ গ্রাম আলু, ৬০ গ্রাম ডাল, ৪৫ গ্রাম ভোজ্যতেল ও ২৫ গ্রাম চিনি থাকা দরকার। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির বাজারদরের তালিকা অনুসারে, তখন একজন শ্রমিকের এক দিনের খাদ্যের জন্য এসব পণ্য পরিমাণমতো কিনতে খরচ হতো ২৩ টাকার কিছু কম। এখন হয় ৪০ টাকার বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সঙ্কট মোকাবিলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে আসন্ন বাজেটে সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তার পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবের পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়ীদের কারসাজিও দায়ী। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন দেন তিনি। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার পুনর্বিন্যাস, করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয়ে নগদ প্রণোদনা বাড়ানো, কৃষিখাতে ভর্তুকি বাড়ানো এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আপদকালীন মজুদ বা ‘বাফার স্টক’ তৈরিতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের সুপারিশ করেন তিনি। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই ধরনের (যুদ্ধকালীন) পরিস্থিতিতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। তার কারণে যে ধরনের অভ্যন্তরীণ অভিঘাতগুলো পড়ে সে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়াটা জরুরি। সেদিক থেকে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ যাতে স্থিতিশীল থাকে সে জায়গাটিতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এই গবেষক বলেন, কেননা সহসা মূল্য কমে যাবে এ ধরনের পরিস্থিতি হয়তো নেই। আরো বেশ কিছুকাল হয়তো মূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকবে। দেশের ভেতর অন্যান্য অনিয়ম যেই হোক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যের এক ধরনের ঊর্ধ্বগতি বিরাজ করবে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে। এ জন্য সরকারের ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে গঠিত বাজার মনিটরিং কমিটিকে বাজার পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও এ সংক্রান্ত সুপরিশ প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি। সেইসঙ্গে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা দুস্থ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং ওএমএসের মতো খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিগুলোতে যাতে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকে, তার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের সুপারিশ করেন গোলাম মোয়োজ্জেম। এ ছাড়া, সঙ্কট উত্তরণে নিত্যপণ্য আমদানিতে সরকার বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদার নিরিখে এবং উৎপাদনের অবস্থা বিচার করে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোতে শুল্ক কমাতে পারে সরকার। শুল্ক কমালে আমদানি ব্যয় কমবে। তাতে হয়তো কিছুটা স্বস্তিদায়ক মূল্যে পণ্যগুলো বাজারে পাওয়া যেতে পারে। এর বাইরে তুলনামূলক কম আয়ের মানুষদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার সুপারিশও করেন তিনি। এর পাশাপাশি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে ডলার সঙ্কটকে ‘আংশিক’ দায়ী বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। এ ক্ষেত্রে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনার বিষয়টিকে উৎসাহিত করতে প্রবাসী আয়ে নগদ প্রণোদনার পরিমাণ আড়াই শতাংশ থেকে আরো বাড়ানোর পরামর্শ দেন। ইনটেনসিভ বাড়ালে হয়তো রেমিট্যান্স বাড়বে। আর ডলারের সরবরাহ বাড়লে হয়তো তা আমদানি পর্যায়ে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী বলেন, দেশের সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থব্যবস্থা বিগত ১৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া এই চাপকে সঙ্কটে পরিণত করেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে বাণিজ্য ঘাটতি ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমতাবস্থায়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে, বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, বিনিয়োগ হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কৃষিকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।