বিল্লাল হোসেন: যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ওয়ার্ডে রাউন্ডে আসেন না। সন্ধ্যা রাতে রোগী ভর্তির পর ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যান। রাত কিছুটা গভীর হলে তাদেরও দেখা মেলেনা। এছাড়া সেবিকারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। রাত ১ টার পর সেবিকাদের কক্ষের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। ডাকলে যেন তারা বিরক্ত হন। একাধিক রোগী স্বজনরা এই অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, চিকিৎসক-সেবিকারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে জরুরি মুহূর্তে রোগীরা উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার রাতে ফলোআপ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না রোগীরা।
হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, রাতে কোন চিকিৎসক ও সেবিকা দায়িত্বে থাকবেন তার রোস্ট্রার আছে। সেই অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করবেন। প্রথমে জরুরি বিভাগ থেকে রোগী ভর্তি হয়ে ওয়ার্ডে আসলে একজন সহকারী রেজিস্ট্রার রোগীকে দেখবেন। প্রয়োজন মতো চিকিৎসাও দেবেন। তাকে সহায়তা করবেন ইন্টার্ন চিকিৎসক। সহকারী রেজিস্ট্রার যদি মনে করেন তাহলে রাতের যে কোনো সময় বিশেষজ্ঞকে অনকলে ডাকতে পারবেন। এর আগে রাত ৯ টা থেকে সাড়ে ৯ টার মধ্যে প্রতি ইউনিটের বিশেষজ্ঞ ওয়ার্ড রাউন্ডে রোগী দেখে যাবেন। তবে বাস্তবে এসব নিয়ম খাতা কলমে সীমাবদ্ধ। কর্তৃপক্ষের নিয়মের কোনো বালাই নেই বললেই চলে।
রোগীর স্বজনদের ভাষ্যমতে, সন্ধ্যার পর কোনো রোগী ভর্তি হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকতো দুরের কথা সহকারী রেজিস্ট্রারও রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে আসেন না। জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসারের ব্যবস্থাপত্র কেটে ইন্টার্নরা নতুন করে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।
যশোর সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামের কবিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৭ টার দিকে সড়ক আহত হন তার ভাই বাপ্পি। তাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালের সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলেও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। ভর্তির পর একজন ইন্টার্ন রোগীকে দেখে যান। তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলে চিকিৎসা। সারারাতে একজন বিশেষজ্ঞ বা সহকারী রেজিস্ট্রার রোগীকে দেখতে আসেননি।
গত ২২ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৭ টার দিকে যশোর শহরের খোলাডাঙ্গায় মতিউর রহমানের ছেলে ইসমাইল (৩৫) ও ইসরাইল (৩০) ছুরিকাহত হন। আহত দুই সহোদরকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। স্বজনদের অভিযোগ, ভর্তির পর রোগীর অবস্থা গুরুতর হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মেলেনি। পরে ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে ইসমাইলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন।
প্রসূতি ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন রমেছা বেগম জানান, প্রসব যন্ত্রণায় রাতভর রোগী ছটফট করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডেকে পাওয়া যায়নি। রাতে ওয়ার্ড রাউন্ডে আসেননি চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালে নিয়মের কোন বালাই নেই।
পূরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন রওশন আলী জানান, অনেক রোগী শারীরিক যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকেন। কিন্তু জরুরিভাবে মেলেনা উন্নত চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রওশন আলী আরও জানান, রাত ১ টার পর সেবিকাদের টেবিল ফাঁকা থাকে। তারা বিশ্্রাম কক্ষের দরজা বন্ধ করে ঘুমান।
হালসা গ্রামের তোরফান আলী জানান, ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাতে তার শিশু সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভোরে ভর্তির পর ১৭ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত তা চিকিৎসাসেবা মেলেনি। চিকিৎসকও রোগী দেখতে আসেননি। জরুরি বিভাগ থেকে লেখা ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ কেনার কাগজ পর্যন্ত দেননি ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সেবিকা। বিষয়টি নিয়ে কথা বললেই এক সেবিকা তার সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেন। পরে ডা. আফসার আলীর আন্তরিকতায় মেলে চিকিৎসাসেবা।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরও কয়েকজন রোগীর স্বজন জানিয়েছেন, ভর্তির পর রাতে চিকিৎসক ওয়ার্ডে ব্যবস্থাপত্র দিতে আসেননা। জরুরি মুহূর্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর সহকারী রেজিস্ট্রার বা ইন্টার্নের চিকিৎসার মান কী এক হবে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গভীররাতে চিকিৎসক সেবিকার অনুপস্থিতিতে কর্মচারী ও আয়ারা থাকে মূল ভূমিকায়। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ রোগীদের।
এই বিষয়ে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. হিমাদ্রী শেখর জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেবিকাদের অনিয়মের বিষয়ে খোঁজ নিবেন তিনি।