নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সব স্থলবন্দরে পণ্য পরিবহন, সংরক্ষণ, হ্যান্ডলিং ও যাত্রীসেবায় মাশুল গড়ে ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ৫ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির কথা জানানো হয়েছে। একই দিনে জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বেনাপোল ব্যতীত কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য স্থলবন্দরগুলোর জন্য নতুন মাশুল কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান স্বাক্ষরিত ওই দুই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নতুন ট্যারিফ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। সরকারের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে যেকোনো সময় এ হার পুনর্র্নিধারণের ক্ষমতাও রাখা হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে স্থলপথে পণ্য বাণিজ্যের বড় অংশ বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি-রফতানি, যানবাহনের চাপ ও রাজস্ব আয়ের দিক বিবেচনায় বেনাপোলকে আলাদা করে ট্যারিফ সূচির আওতায় রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেনাপোল বন্দরের জন্য জারি করা প্রজ্ঞাপনে ২০২৫ সালের বিদ্যমান ট্যারিফের সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ যুক্ত করে নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে যানবাহন প্রবেশ ফি, গুদাম ও খোলা আঙিনায় পণ্য সংরক্ষণ, হ্যান্ডলিং চার্জ, নথিপত্র প্রস্তুত, যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং যাত্রীসেবাসহ প্রায় সব খাত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, বেনাপোল স্থলবন্দরে ট্রাক, বাস ও লরির প্রবেশ ফি বাড়িয়ে প্রতি প্রবেশে ১৮৪ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি, জিপ ও পিকআপের ক্ষেত্রে প্রবেশ ফি দাঁড়াচ্ছে ১১০ টাকা ৮২ পয়সা। ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল ও ভ্যানের ক্ষেত্রেও প্রবেশ ফি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া পণ্যের ওজন পরিমাপ, অতিরিক্ত নথিপত্র প্রস্তুত, গুদামে যানবাহনের অবস্থান এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক সেবার ফি নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রতিটি চালানে আগের তুলনায় বাড়তি খরচ যুক্ত হবে।
বেনাপোল বন্দরে প্রথম তিনদিন বিনা খরচে পণ্য রাখার সুবিধা বহাল থাকছে। তবে এরপর ধাপে ধাপে গুদাম ও ইয়ার্ডে সংরক্ষণের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ পণ্যের ক্ষেত্রে গুদামে প্রতি টনের জন্য দৈনিক ভাড়া ১৩ টাকা ৯৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ২০২৫ সালে ছিল ১৩ টাকা ৩১ পয়সা।
সুতা, কাপড়, চা, কাগজ, চামড়া, কাঠসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও সংরক্ষণ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন ট্যারিফে টায়ার, টিউব, মোটরসাইকেল, তিন চাকার যান, ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্রাক ও ট্রেইলারের জন্য গুদাম ও খোলা আঙিনায় সংরক্ষণ খরচ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে আগের তুলনায় বাড়ছে মোবাইল ক্রেন, ফর্কলিফট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভাড়াও।
শ্রমিক দিয়ে পণ্য ওঠা-নামা ও গুদামে সাজানোর ক্ষেত্রে প্রতি টনে হ্যান্ডলিং চার্জ বাড়িয়ে ৫৫ টাকা ৭৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ব্যবহারে হ্যান্ডলিং খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বেনাপোল যাত্রী টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য প্রবেশ, অপেক্ষা ও সেবা চার্জ মিলিয়ে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫২ টাকা ২৭ পয়সা, যা আগে ছিল ৪৯ টাকা ৭৯ পয়সা।
বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের একটি অংশ বলছেন, এ ট্যারিফ বৃদ্ধি আমদানি ব্যয় আরো বাড়াবে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, কাঁচামাল ও শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ শেষ পর্যন্ত বাজারদরে প্রতিফলিত হতে পারে। বেনাপোল স্থলবন্দর আমদানি-রফতানি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘বন্দরের সেবার মাশুল বাড়লে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, এর প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়বে।’
যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এজাজ উদ্দিন টিপু বলেন, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে। এ অবস্থায় স্থলবন্দরের মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আশা করছি সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্ত অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ট্যারিফ সমন্বয়ের বিধান আগে থেকেই ছিল। নতুন এ হার সেই ধারাবাহিকতার অংশ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রয়োজনে যেকোনো সময় ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ করা হতে পারে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ট্যারিফের দ্বিগুণ চার্জ প্রযোজ্য হবে। রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে গুদাম ভাড়ায় ১০ শতাংশ ছাড় বহাল থাকবে। সব ধরনের চার্জের ওপর সরকার নির্ধারিত হারে মূল্য সংযোজন কর আদায় করা হবে।
ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত কেবল বন্দর ব্যবহারকারীদের নয়, সামগ্রিকভাবে সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাজারদরের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
একই দিনে জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বেনাপোল ব্যতীত বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য সব স্থলবন্দরের ক্ষেত্রেও ২০২৫ সালের ট্যারিফের ওপর ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সালের হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ সিদ্ধান্তের আওতায় ভোমরা, বুড়িমারী, তামাবিল, আকহোরা, সোনামসজিদসহ অন্যান্য স্থলবন্দরে যানবাহন প্রবেশ, গুদাম ভাড়া, হ্যান্ডলিং ও আনুষঙ্গিক সেবার খরচ বাড়বে। এসব বন্দরের ক্ষেত্রেও নতুন ট্যারিফ ১ জানুয়ারি ২০২৬ থেকে কার্যকর হবে।
বেনাপোল ছাড়া অন্যান্য স্থলবন্দরের ক্ষেত্রেও সাধারণ শর্তাবলিতে চার্জ আদায় ও ছাড় সুবিধা নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে আমদানি ম্যানিফেস্ট, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, কনসাইনমেন্ট নোট বা ট্রাক চালানে ওজন বা পরিমাপে ভুল ঘোষণা ধরা পড়লে প্রকৃত ওজন বা পরিমাপ যেটি বেশি হবে তার ভিত্তিতে ভাড়া আদায়ের পূর্ণ ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের থাকবে। বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাড়ার দ্বিগুণ, অর্থাৎ ২০০ শতাংশ হারে চার্জ আরোপ করা হবে। সরকারি আদেশ বা কাস্টমসের কোনো বাধ্যবাধকতার কারণে পণ্য খালাসে বিলম্ব হলে এবং তা যথাযথভাবে প্রত্যয়ন করা থাকলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ল্যাবের ভাড়া ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর সুযোগ রাখা হয়েছে, একই সুবিধা নিলামের জন্য কাস্টমসের কাছে হস্তান্তরিত কিন্তু নিলামের আগেই খালাস হওয়া পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। রফতানি পণ্যের জন্য গুদাম ভাড়ায় ১০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সব খোলা পণ্যের ওজন বা পরিমাপ নিজস্বভাবে নির্ধারণ করতে পারবে এবং ন্যূনতম এক টন বা এক ঘনমিটার ধরে ভাড়া আদায় করা হবে। ভাড়া বিলের ক্ষেত্রে ৫০ পয়সার কম ভগ্নাংশ বাদ এবং ৫০ পয়সা বা তার বেশি হলে এক টাকা হিসেবে গণনা করা হবে। খোলা ইয়ার্ডে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা পণ্যের ক্ষেত্রে ত্রিপলের ভাড়া না নিয়ে ট্রানজিট শেডের ভাড়া আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে।
বন্দরের স্বার্থে পণ্য সরানো বা পুনর্বিন্যাসে কোনো চার্জ নেয়া হবে না, তবে আমদানিকারক বা এজেন্টের আবেদনে তা করা হলে নির্ধারিত চার্জ আদায় করা হবে। সব ভাড়ার ওপর সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে এবং নতুন করে হার পুনর্র্নিধারণ না হলে প্রতি বছর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৫ শতাংশ হারে ট্যারিফ বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে।
বিধানে বলা হয়েছে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অনুযায়ী বুড়িমারী স্থলবন্দরে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে লোডিং-আনলোডিং চার্জ কেবল তখনই কার্যকর হবে, যখন কর্তৃপক্ষ সেখানে সেই সুবিধা প্রদান করতে পারবে।