জীবিত থাকা নাকি বেঁচে থাকা

এখন সময়: শুক্রবার, ২৯ মার্চ , ২০২৪, ০১:৩৯:৩৪ এম

এলিজা শরমিন : "জীবনের চেকলিস্ট নিয়ে যখন বসবে, একটা একটা করে টিক চিহ্ন দিবে। দেখবে চাকরি পেয়েছো, জীবনসঙ্গী পেয়েছো, নিজের একটা ঘর পেয়েছো, তখন নিজেকে প্রশ্ন করো, জীবনে কি তুমি সত্যিই এগুলো পেতে চেয়েছো? নাকি এগুলো চাও বলে ধরে নিয়েছো? জীবিত থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য এটাই। জীবন একটা রোমাঞ্চকর গল্পের বদলে যেন শ্রেফ চাকরির সিভির মতো হয়ে না যায়।"

উপরের কথাগুলো আমার নয়। মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক অ্যানা কুইন্ডলেনের। আমি এই কথাগুলোকে ভীষণভাবে সমর্থন করি। জীবনের সাফল্য বলতে আমরা বেশিরভাগ মানুষ আর্থিক লাভ, পজিশন, এগুলো অর্জন করাকেই বুঝি। কিন্তু এগুলো অর্জন করতে গিয়ে আমরা জীবনের সবটুকু সময় খরচ করে ফেলি। আপাতদৃষ্টিতে আর্থিকভাবে সফল মানুষ যখন মৃত্যুশয্যায় থাকে তখন সেই মানুষগুলো ভীষণভাবে দার্শনিক হয়ে পড়ে। পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যা কিছু অর্জন করতে চেয়েছে হয়তো সেগুলোর অধিকাংশই করায়ত্ত করতে পেরেছে কিন্তু জীবনের নিরন্তর দৌড়ে চলার মাঝে মাঝে আনন্দ পাওয়ার জন্য যে থামতে হয়, তা সঠিক সমতয় বুঝতে পারেনি বা পারলেও সেটা করেনি।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যখন অর্থ-বিত্ত, পজিশন নিয়ে দৌড়ে বেড়ায় তখন কিছু মানুষ তাদের চিন্তাভাবনা অন্য পথে নিয়ে যায়। যেমন কেউ কেউ বিনা স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগিয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ পশুপাখিদের আচরণ নিয়ে নানান গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং তাদের সাথে সময় কাটাচ্ছে, কেউ আকাশ, কেউ সমুদ্র নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।  পড়ে আছে সারাক্ষণ এইগুলো নিয়েই। আবার কেউ সামান্য অর্থ যোগাড় হলেই একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে। পানির ধারে, বনের মধ্যে ছোট্ট একটা তাবু টাঙিয়ে কয়েকদিন একাই কাটিয়ে আসে প্রকৃতির সাথে। কথা নেই, শুধু সৃষ্টিকর্তার সৌন্দর্য দেখা এবং নিজেকে সময় দেওয়ার জন্যই এসব করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী স্টিভ ইরউইন-এর কথা। যাকে আমরা ডিসকভারি চ্যানেলে প্রায় সবাই দেখেছি। যার কাজই ছিলো পশুপাখি, সাগরের নিচের প্রাণীদের সাথে সময় কাটানো। তাঁর কারণেই আমরা অনেক প্রাণীর সাথে পরিচিত হয়েছি, অনেক অজানাকে জানতে পেরেছি। ২০০৬ সালে  'স্টিং রে' মাছের লেজের আঘাতে সমুদ্রের তলদেশেই তাঁর মৃত্যু হয়। মুহূর্তক্ষণ আগেও তিনি বুঝতে পারেননি যে মৃত্যু তাঁর খুব কাছাকাছি ছিলো। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আনন্দেই কাটিয়েছিলেন। যা করতে চেয়েছিলেন তা করতে পেরেছেন। এজন্য হাসিমুখেই তার মৃত্যু হয়েছে। অনেকে এই মানুষগুলোকে পাগল বলে। কিন্তু আমি বলি, এরাই জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পেয়েছে।

আমরা অনেকেই শৈশব কৈশোরের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কি সুন্দরই না ছিলো সেসব দিন! কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, তখন কি আমাদের হাতে টাকা-পয়সা থাকতো? থাকতো না- কিন্তু আনন্দ কেন পেতাম বলতে পারেন? নিজেদের এই প্রশ্ন কখনো করে দেখেছেন? আনন্দ পেতাম এই কারণে যে, জীবনের আসল অর্থ তখন না জানলেও তার সঠিক ব্যবহারটা করতে পেরেছিলাম৷ অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কেন সেইসব দিন ফিরে আসে না। কিন্তু আমি বলবো, এখনো তো সাঁতার কাটা যায়, বৃষ্টিতে ভেজা যায়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া যায়। অতীতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়না ঠিকই কিন্তু অতীতের কাজগুলো আমরা বর্তমানে নিয়ে আসতে পারি।

আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক সেনেকা 'অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ' বইয়ে বলেছিলেন, "এমন নয় যে বেঁচে থাকার জন্য আমরা ক্ষুদ্র সময় পাই। বরং জীবনের অধিকাংশ সময় আমরা নষ্ট করি। আসলে জীবন ছোট নয় বরং নিজেদের অদরকারি কথাবার্তা, অপছন্দের কাজ করার পেছনে সময় ব্যয় করি।"

জীবন নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা দোষের কিছু না, কিন্তু যে স্বপ্ন বা কাজ আপনাকে স্বস্তি দেয় না, শান্তি দেয় না, সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করা নিরর্থক। আমরা জানিই না মুহূর্ত মুহূর্ত করে যে সময় চলে যাচ্ছে তার স্বাদ কেমন! আজীবন সবকিছুতে আমরা আর্থিক লাভ খুঁজি। কিন্তু জীবনে আমরা আসলে কি হতে চাই এবং কি হচ্ছি তার পার্থক্য খুঁজে দেখিনা। তাইতো পৃথিবীর অনেক বিত্তবান মানুষ জীবনের শেষ সময়ে উপলব্ধি করেছেন, তার জীবনটা আসলে কখনো তার ছিলই না। যার পিছনে ছুটেছেন আজীবন তা তিনি আসলে চাননি- যা চেয়েছেন তা খুঁজে দেখেননি।

বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে আমরা কে না জানি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর অদ্ভুত আচার-আচরণের কারণে স্কুলে কখনো ভালো রেজাল্ট করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা কি অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যাবে? তাঁর জীবনকে সফল বলবো কারণ তিনি গতানুগতিক জীবনের বাইরে অন্য কিছু করতে চেয়েছেন এবং সেটা করতে পেরেছেন। তাঁর কথা দিয়েই আজকের লেখা শেষ করছি- "কাল আমার পরীক্ষা, কিন্তু এটা আমার কাছে বিশেষ কোন ব্যাপারই না। কারণ শুধুমাত্র পরীক্ষার খাতার কয়েকটা পাতাই আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেনা।" (বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন)