বিল্লাল হোসেন ও মিরাজুল কবীর টিটো: চলে গেলো ১৮ শ্রাবণ। ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা নেই বললে চলে। মাঝে মধ্যে ছিটে -ফোটা বৃষ্টি হলেও কৃষকের কোনো উপকারে আসছে না। এর আগে আষাঢ় মাস চলে গেলো বৃষ্টি শূন্যতার মধ্য দিয়েই। প্রচণ্ড খরায় অনেক কৃষকের ধানের চারা পুড়ে গেছে। ক্ষেত ফেটে হয়েছে চৌচির। বৃষ্টির তেমন দেখা না পাওয়ায় আমন চাষ, পাট জাগ দেয়া নিয়ে কৃষকরা চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে। মঙ্গলবার যশোরে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও চলতি সপ্তাহে আর বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নেই বলছেন আবহাওয়া অফিস। এদিকে, হাসপাতালেও বেড়েছে আবহাওয়া জনিত রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে এমন পরিস্থিতি চলছে। এটাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে। মুরব্বীরা বলছেন, ভরা বর্ষায় বৃষ্টিহীন সময় যেনো তারা স্মরণকালে প্রথম দেখলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোরো মৌসুমে হিটস্ট্রোকে যশোর জেলায় অনেক অনেক স্থানে জমির ধান পুড়ে যায়। আবার ধান ধরে তোলার সময়কালে অসময়ের বৃষ্টি কৃষকের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির পানিতে ভেসে এক জনের ধান চলে যায় আরেক জনের ক্ষেতে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। এদিকে আবার ভরা মৌসুমে যশোর অঞ্চলে বৃষ্টির তেমন দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে স্যালোমেশিনে পানি তুলে অনেক কৃষক রোপা আমন চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
যশোর সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামের শফিয়ার রহমান জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করার জন্য চারা দিয়েছেন। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে চারা ভালো হয়নি। বাধ্য হয়ে স্যালোমেশিন দিয়ে ক্ষেতে পানি দিয়েছেন। আবার অনেকের ধানের চারা ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
আরেক কৃষক জসিম উদ্দিন জানান, ভরা মৌসুমে বৃষ্টির পানির দেখা নেই। এতে আমন ধান চাষে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্যালোমেশিনের পানিতে জমি প্রস্তুত করে ধান করতে হচ্ছে।
আরিচপুর গ্রামের লোকমান হোসেন জানান, পানির অভাবে পাট জাগ দেয়া নিয়ে তার মতো অনেক কৃষক চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। আশে পাশের পুকুর, খাল বা খানা খন্দে পানি নেই।
ইয়াকুব আলী নামে এক বৃদ্ধ কৃষক জানান, যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন হচ্ছেনা। আর যখন বৃষ্টির প্রয়োজন তখন বৃষ্টির দেখা নেই। মাঝে মধ্যে হালকা পরিমাণে বৃষ্টি হলেও কৃষকের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। সামান্য বৃষ্টির পর প্রচন্ড খরায় মুহূর্তে ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে অনেকে পাট জাগ দিতে পারছেন না। ভারি এক সমস্যা চলছে। ধান চাষ করা নিয়েও বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। তার ৭৫ বছরের জীবনে এই ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর চোখে পড়েনি।
চুড়ামনকাটি গ্রামের উত্তরপাড়ার শহিদুল ইসলাম জানান, বৃষ্টির অভাবে সবজি চাষেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অনেকে। বাঁধা কপি ও ফুলকপির তেমন ওজন বাড়ছে না।
কৃষক শামসুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, ইন্তাজ আলী, আমিন বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজন জানান, পুরো আষাঢ় বৃষ্টিহীন পার হয়েছে। ইতিমধ্যে শ্রাবণ মাসের ১৮ দিন অতিবাহিত হলো। কিন্তু তেমন বৃষ্টি নেই। ভরা মৌসুম শেষ হয়ে এলেও বৃষ্টির অভাব আর প্রচণ্ড তাপদাহে কৃষক ও প্রাণিকুল হাঁসফাঁস করছে। তারা চাষাবাদে চরম বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
যশোর সদর উপজেলার, ঝিকরগাছা উপজেলা , চৌগাছা উপজেলা ও শার্শা উপজেলার কয়েকটি মাঠে গিয়ে দেখা গেছে বৃষ্টির পানির অভাবে অনেকে পাট জাগ দিতে পারছেন না। কাঁচা পাট নিয়েও সেখানকার কৃষকরা ভোগান্তিতে রয়েছেন। অনেকে আবার বৃষ্টির পানির আশায় পাট কেটে ক্ষেতে রেখে দিয়েছেন।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আব্দুস সামাদ জানান, বর্তমানে হাসপাতালে আবহাওয়া জনিত রোগীর চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা।
যশোর সরকারি মহিলা কলেজের ভুগোল ও পরিবেশের সহযোগী অধ্যাপক সেলিনা খাতুন বলেছেন, দেশে অধিকাংশ পুকুর, খাল বিল ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পুকুর খাল বিল কমে যাওয়ায় জলবায়ু সৃষ্টি হতে না পারায় বৃষ্টি হচ্ছে না। এর পাশাপাশি বৃক্ষ নিধন করায় বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়ে গেছে। এসি ব্যবহার করায় গ্রীন হাউজ গ্যাস বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, বৃষ্টিপাতের অভাবে নদ-নদী, খাল-বিলসহ পানির উৎসগুলো প্রায় তলানিতে। পানি ধারণক্ষমতার নিচে চলে যাওয়ায় ফল-ফসল রক্ষায় গভীর নলকূপ এবং প্রচলিত দেশীয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিকল্প উপায়ে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষককে। জমি ভিজিয়ে রাখতে হচ্ছে কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে। এতে করে কৃষি-ক্ষেত খামারে আবাদ ও উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে।
যশোর বিমানবন্দর সংলগ্ন আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর তাপমাত্রা ছিলো ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূত্রটি আরও জানায়, চলতি সপ্তাহে কৃষকের জন্য আর খুশির বার্তা নেই। কারণ ভারী বৃষ্টিপাতের কোন সম্ভাবনা দেখছেন না। ফলে কৃষকের দুর্ভোগ থেকেই যাচ্ছে।