আপেল খাওয়ানোর পর হত্যা করে আঞ্জুয়ারা

চালের ড্রামে শিশু জান্নাতের লাশ

এখন সময়: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১০:৩৮:২০ পিএম

বিল্লাল হোসেন: চার বছরের ছোট্ট শিশু সানজিদা জান্নাত। খেলতে খেলতে শনিবার দুপুর ১২ টার দিকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়। মেয়ের সন্ধান না পেয়ে পাগল প্রায় বাবা সোহেল রানা ও মা শরিফা বেগম সন্ধ্যায় ছুটে আসেন যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায়। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর কপি নিয়ে যান পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অফিসে। সানজিদার সন্ধান মেলাতে সফল হয় ডিবি। কিন্তু ততক্ষনে ফুটফুটে সানজিদা পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। প্রতিবেশী নারী আঞ্জুয়ারা তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ লুকিয়ে রাখে নিজ ঘরের চালের ড্রামের মধ্যে। আঞ্জুয়ারার স্বীকারোক্তিতে রাত ১১ টার দিকে পুলিশ সানজিদার মৃতদেহ উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের পতেঙ্গালী গ্রামে। নিহতের মা শরিফা জানান, আঞ্জুয়ারা বেগম ও তার স্বামী রেজাউল ইসলামের অপরাধ জগতের তথ্য জানতেন বলে তারা সানজিদাকে খুন করেছে। আঞ্জুয়ারার বাক প্রতিবন্ধী শিশু ছেলেক “পাগল” বলে  ডাকার কারণেও সানজিদার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলো তারা। হত্যার ঘটনায় রোববার ২ জনকে আসামি করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা এই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। ছোট্ট শিশুটিকে নির্দয়ভাবে হত্যার ঘটনায় আঞ্জুয়ারার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পতেঙ্গালী গ্রামে রীতিমতো শোকের ছায়া নেমে এসেছে। 

যশোর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম জানান, পতেঙ্গালী গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক সোহেল রানার মেয়ে শিশু সানজিদা নিখোঁজের জিডির কপি নিয়ে অনুসন্ধানে বের হন। প্রতিবেশী রেজাউল ইসলামের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা অসংলগ্ন কথাবার্তায় পুলিশের সন্দেহ হয়। তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন ঘটনার দিন দুপুরে আপেল দেওয়ার কথা বলে তিনি শিশু সানজিদাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যান। এরপর সানজিদাকে তিনি আপেল খাওয়ান। এরপর প্রথমে  নিজের ব্রা ও গামছা দিয়ে হাত-পা বাঁধে। পরে ওড়না গলায় পেচিয়ে ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘরের সিঁড়ির নিচে রাখা চালের ড্রামে লাশ লুকিয়ে রাখে আঞ্জুয়ারা। গভীর রাতে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। আঞ্জুয়ারা শার্শা উপজেলার পুটখালী  গ্রামের উত্তরপাড়ার রেজাউল ইসলামের স্ত্রী। তারা পতেঙ্গালী গ্রামে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন।

এসআই মফিজুর রহমান আরও জানান, আঞ্জুয়ারা দুটি কারণে সানজিদাকে হত্যা করতে পারে। একটা হলো আঞ্জুয়ারার বাকপ্রতিবন্ধী একটি ছেলে রয়েছে।

খেলার সময় তার ছেলে সানজিদাকে প্রায় মারধর করত। এতে সানজিদা রেগে গিয়ে তাকে ‘পাগল’ বলে ডাকত। ছেলের এই অপমানে আঞ্জুয়ারা মানসিক কষ্টে ক্ষুব্ধ হয়। আরেকটি কারণ হলো সানজিদার মা শরিফা বেগম বিগত দিনে পুটখালীতে থাকতেন। সেই সময় কোনো  একটা বিষয় নিয়ে আঞ্জুয়ারার সাথে শরিফার মনোমালিন্য হয়। এরই জেরে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে আঞ্জুয়ারা শরিফার মেয়েকে খুন করতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

এদিকে, সানজিদার পিতা সোহেল রানা বাদী হয়ে আঞ্জুয়ারা ও তার স্বামী রেজাউল ইসলামকে আসামি করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় হত্যার দুটো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। 

মামলার এজাহার মতে, আঞ্জুয়ারা খাতুন ও তার রেজাউল ওরফে রেজা নানা অপরাধের সাথে জড়িত। সানজিদার মা শরিফা তাদের অপরাধের তথ্য জানতেন। এছাড়াও শিশুদের গোলযোগের সময় আঞ্জুয়ারার  বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেকে “পাগল” বলে ডাকার কারণে আঞ্জুয়ারা শিশু সানজিদার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলো। এরই জের ধরে রেজাউল ইসলামের পরিকল্পনায় তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা ছোট্ট সানজিদাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

এদিকে, রোববার বিকেলে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে শিশু সানজিদাকে হত্যার রহস্যের উদঘাটন প্রকাশ করা হয়েছে।

যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তাজুল ইসলাম জানান, শিশু সানজিদাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িত আঞ্জুয়ারাকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুরুল ইসলামের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন আঞ্জুয়ারা। আরেক আসামি রেজাউলকে আটকের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

নিহতের বাবা সোহেল রানা জানান, সানজিদা আমার একমাত্র সন্তান। নিষ্পাপ এই শিশুকে আঞ্জুয়ারা নির্দয়ভাবে খুন করেছে। তিনি সন্তান হত্যাকারীর সর্বোচ্চ বিচার দাবি করেছেন।

মা শরিফা বেগম জানান, আমার সোনা কি এমন অপরাধ করেছিলো। যে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। আঞ্জুয়ারা মানুষ রুপে জানোয়ার। তার ও তার স্বামী শিশু পাচার, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধের তথ্য আমি জানতাম। কিন্তু কখনো তাদের তথ্য পুলিশ প্রশাসনকে অবগত করিনি। তাহলে কেনো আমার ছোট্ট সোনাকে এভাবে খুন করা হলো।

শরিফা আরও জানান, সানজিদা নিখোঁজ হওয়ার পর আঞ্জুয়ারার কাছে জানতে চাইলে বলা হয়। পাশের পুকুরে গিয়ে দেখেন । পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে। কে জানতো তার বুকের ধনকে ও ডাইনী খেয়েছে। হাউমাউ করে কাঁদছিলেন শরিফা বেগম।

এদিকে, পতেঙ্গালী গ্রামে গিয়ে জানা যায়, আঞ্জুয়ারা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল ধার করেন। এখন তারা বুঝতে পারছেন সানজিদাকে হত্যার পর লাশ লুকানোর জন্য একাধিকজনের কাছ থেকে কেজি কেজি চাল ধার করেন।

আব্দুল মালেক ও মুজিবুল ইসলাম নামে দুই জন জানান, রেজাউল ইসলাম ও আঞ্জুয়ারা দুইজনই মন্দ প্রকৃতির মানুষ। পতেঙ্গালী আসার পর বিভিন্ন মানুষের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব হয়।

আরেকজন আজিজুর রহমান রহমান, রেজাউল ইসলাম ও আঞ্জুয়ারা পুটখালী থাকাকালীন মাদক ব্যবসাসহ অবৈধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন। এরপরেও নানা কারণে তারা পতেঙ্গালী গ্রামে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছিলেন।  আঞ্জুয়ারাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অপরাধ জগতের তথ্য মিলতে পারে।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য রুহুল আমিন জানান, রোববার দুুপরে ময়নাতদন্ত শেষে সানজিদার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শিশু সানজিদাকে হত্যার ঘটনায় পতেঙ্গালী গ্রামে শোকের ছায়া বিরাজ করছে।