আবদুল কাদের: দলীয় নেতা-কর্মীদের পদচারণায় এখন গম গম করছে শহরের লালদীঘির পাড়ে অবস্থিত যশোর বিএনপির কার্যালয়টি। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এমন ভিড় লেগে থাকে যে, ঠেলে কার্যালয়ে ঢুকতে হচ্ছে নেতাদের। কিন্তু বিএনপি কার্যালয়ের এমন চিত্র গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। তার আগে বিগত সরকারের সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশি বাঁধার কারণে দলীয় কার্যালয়টি খুলতে পারতো না। কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠান করতে গেলে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হতে হয়েছে নেতা-কর্মীদের।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিএনপির কার্যালয়ে লোকসমাগম থাকলেও তা এত ব্যাপক ছিল না। বরং অনেকবারই কার্যালয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ আগস্টও আগুন দেয়া হয় জেলা বিএনপির কার্যালয়টিতে। এছাড়া জেলা বিএনপির শীর্য নেতারা মারধরের শিকার হয়েছেন। একজন হয়েছেন ছুরিকাহত। শত নির্যাতনের মধ্যেও যশোর বিএনপিকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। বর্তমানে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি না থাকলেও নগর বিএনপির আয়োজনে ফুটবল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মীদের চাঙ্গা করে রাখছেন তিনি।
২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিনও কার্যালয়টি খুলতে পারেনি বিএনপি। এরপর কোটা আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাইও কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সাড়ে ১৫ বছর বিএনপি যখনই বড় কোনো সমাবেশ বা কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ঠিক তখনই কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চারপাশের সড়ক পুলিশ যান ও মানুষ চলাচল বন্ধ করে রাখত। তখন লালদীঘি এলাকা থাকত সুনসান নীরবতা। এলাকাবাসীর মধ্যেও ছিল অজানা ভয় ও আতঙ্ক। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বদলে গেছে চিত্র। এখন জেলা বিএনপির কার্যালয়ে শত শত নেতা-কর্মী প্রতিদিন ভিড় করেন। তাদের অনেকে আসেন শুধু আড্ডা দিতে।
নতুন এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন আতঙ্কমুক্ত পরিবেশে দলীয় অফিসে ঢুকতে পারছেন। বিগত ১৫-১৬ বছর আমাদের মুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করতে দেয়া হয়নি। জেলা বিএনপির এমন কোন শীর্য নেতা নেই যার নামে ৩০-৫০টি মামলা নেই। কিছু নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে ৫০টিরও বেশি মামলা। শুধু পুলিশি নির্যাতন নয়, আমরা ভোগ করেছি বিগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলা। দলীয় কার্যালয় একাধিকবার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমাকেসহ সিনিয়র নেতাদের লাঞ্চিত করা হয়েছে। জেলা বিএনপির নেতা গোলাম রেজা দুলুকে ছুরিকাহত করা হয়। তারপরও আমাদের নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নেতৃত্বে আমরা শত বাঁধা উপেক্ষা করে রাজপথে ছিলাম।
তিনি বলেন, পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্য নেতাদের কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে আওয়ামী লীগের আজকের এই পরিণতি হতো না।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলা বিএনপির কার্যালয় এখন সরগরম হয়ে উঠছে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের পদচারণে। তাদের মধ্যে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের এখন যাতায়াত বেড়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের প্রয়াত স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইষরামের ছবিসংবলিত বড় একটি বিলবোর্ড রয়েছে। এই বিলবোর্ড সহজেই সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পার্টি অফিসে কেউ এসেছেন এমনিতে, আবার কেউ এসেছেন দলীয় কাজে।
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার ও আতঙ্ক ছাড়াই কার্যালয়ে এসেছেন। দলের কার্যালয় এখন তাদের কাছে নিরাপদ। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর পর মুক্ত বাংলাদেশ পেলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের উদ্দেশ্য এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আগামী সংসদ নির্বাচন কবে হবে- অন্তর্বর্তী সরকার ১১ মাস পার করলেও এখনো তা পরিষ্কার করছে না।
পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনে বলেন, বিগত সময়ে বাড়ি ঘুমাতে পারেনি। ব্যবসা করতে পারেনি। সবসময় পুলিশি আতংক বিরাজ করত। দলের দুঃসময়ে মিছিল সমাবেশে সব সময় যোগ দিয়েছি। সময় পেলেই পার্টি অফিস আসা হয়। আগে ভয় ও আতঙ্ক থাকলেও এখন তা নেই।
ঝিকরগাছার মাটিকুমড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি বিএনপির একজন সমার্থক। ‘এবারই প্রথম পার্টি অফিসে এসেছি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ বা পরিচয় নেই। তবে দলের একজন সমর্থক হিসেবে কাজের ফাঁকে বিএনপির মিছিল সমাবেশে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে বিএনপির কাছ থেকে আমার চাওয়া বা পাওয়ার কিছু নেই। বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে নজর দেওয়া উচিত হবে। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে এবং মানুষকে সম্মান দিতে হবে।
জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে বেশ কিছু তরুণকে সেলফি তুলতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, তারা যশোরে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। তাদের অনেকে উপজেলা পর্যায়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যেহেতু শহরে এসেছেন, তাই বিএনপির কার্যালয়ে এসে সেলফি বা ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তারা বলেন, দেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যাবে না।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মোস্তফা আমির ফয়সাল বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গ্রেপ্তার, নির্যাতন-নিপীড়নের ভয় উপেক্ষা করে বিএনপির প্রতিটি মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি। বেশিরভাগ সময় থাকতে হতো পরিবারকে ছাড়াই। এমনকি কয়েক বছর ঈদ কেটেছে জেলখানায়। জামিন পেলেই আবারও পুলিশি নির্যাতন নেমে আসত।
আগেও প্রায়ই পার্টি অফিসে আসতাম এবং এখন তো নির্ভয়ে আসি। মুক্ত বাংলাদেশে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলীয় কার্যালয়ে আসছেন।
বিএনপির কার্যালয়ে অফিস করছেন দপ্তরের দায়িত্বশীল নেতারা। সিনিয়র নেতারা দলীয় কর্মসূচি পালন ও নিয়মিত অফিস করছেন। বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত যশোরে থাকলে দলীয় কার্যালয় নিয়মিত যেয়ে থাকেন। তিনিই যশোর বিএনপিকে চাঙ্গা করে রেখেছেন বলে দলীয় নেতারা জানান। বিগত সময়ে শত বাঁধা পেরিয়ে দলীয় কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছিলেন তরুণ এই কেন্দ্রীয় নেতা। এছাড়া জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, নগর বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুল্লুক চাঁদ, সহসভাপতি কাওছার আহমদ, সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হক সেতু, সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান মাসুমসহ নেতারা নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে যেয়ে থাকেন।
এছাড়া যুবদল, ছাত্রদল, কৃষকদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারাও কার্যালয়ে নিয়মিত যাচ্ছেন।
৫ আগস্টের পর লালদীগির পাড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নেই বললেই চলে। অথচ এর আগে সাড়ে ১৫ বছর ওই এলাকার আশপাশের এলাকায় শত শত পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। এখন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। কেউ কেউ বিক্রি করছেন পেঁয়াজু-পাকোড়া, কাবাব। বেচাবিক্রিও ভালো বলে জানান বিক্রেতারা।
জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, বর্তমানে নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসছেন। আগে গ্রেপ্তার ও পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেও নেতাকর্মীরা নিয়মিত অফিসে আসতেন। এখন সেই ভয় ও আতঙ্ক থেকে দেশবাসী মুক্তি পেয়েছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে আওয়ামী লীগের আজকে এই দশা হতো না।
তিনি বলেন, মুক্ত বাংলাদেশে, মুক্ত অবস্থায় এখন পার্টি অফিসে আমরা নির্ভয়ে আছি। এখন পার্টি অফিসে আসতে কেউ মানা করে না, কেউ ভয় দেখায় না, নিজের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই- এটাই মুক্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশের পার্থক্য। তবে এখনো গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়নি। তিনি বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর আমরা যে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি, ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলেও এত অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করেনি কেউ।
এক প্রশ্নের তিনি বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা জেল-জুলম, গুম-খুন মোকাবিলা করতে করতে সিজনড পলিটিশিয়ান হয়ে গিয়েছিলেন। যে কারণ শত ভয়-আতঙ্ক, মৃত্যুর হাতছানি- এগুলো সত্ত্বেও তারা পার্টি অফিসে আসতেন। নেতাকর্মীদের সাহস দিয়ে মনোবল চাঙ্গা রেখেছিলেন আমাদের নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তবে পুলিশি হামলা ও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সবাই সতর্ক থাকতেন।
তিনি বলেন, আমাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে পুরোপুরি হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, এই সরকার গায়েবি ও মিথ্যা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক অবশিষ্ট মামলাগুলো নির্বাচনের আগে নিষ্পত্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।
এব্যাপারে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাবস্থায় বিএনপির উপর নির্যাতনের স্টিম রুলার চালিয়েছে। হামলা মামলা ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। দলীয় কার্যালয়ে ৫-৬ বার হামলা ও আগুন দেয়া হয়েছে। শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে। আমার ঘোপস্থ বাড়িতেও একাধিকবার বোমা হামলা করেছে। আমার নামে যশোর, খুলনা ও ঢাকায় ৭০টি মামলা করা হয়েছে। জেলা বিএনপির শীর্য নেতাদের বিরুদ্ধে গড়ে ৫০টি করে মিথ্যা মামলা রয়েছে। কয়েক বছর ঈদ কেটেছে জেলখানায়। এতো নির্যাতন সহ্য করেও আমরা মাঠের রাজনীতির হাল ছাড়েনি। দলীয় কর্মসূচি চালিয়েছি। নেতাকর্মীরা আগেও পার্টি অফিসে আসতেন, এখনো আসেন। যখন যার প্রয়োজন হয় তখনই তিনি অফিসে আসেন। হামলা-মামলা, খুন-গুম থেকে শুধু বিএনপি নয়, জাতি মুক্তিলাভ করেছে।
তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেওলিয়া হয়ে পড়েছিল। জনগণের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিলনা। তারা পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর ভর করে রাজনীতি করেছে। পরপর তিনটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে দলটির রাজনৈতিক মুত্যু ঘটেছে। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকতে যেয়ে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব হারিয়েছে আওয়ামী লীগ।