স্পন্দন ডেস্ক: জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছে বিএনপি।
বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনা আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।
“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।”
জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। তবে কখন সেই ভোট হবে তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রবল মতবিরোধ রয়েছে।
ভিন্ন দিনে গণভোট ‘অযৌক্তিক’
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্থে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টাৃ সেক্ষেত্রে (সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।
“সময় স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অংকের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণ এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
“সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা আমাদের সকলের কাম্য এবং জুলাই গণভুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং উক্ত জাতীয় সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান প্রকাশে আমরা দায়বদ্ধ।”
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানে আমরা একমত হয়েছি জাতির স্বার্থে, ঐক্যের স্বার্থে। এর বাইরের আমরা কোনদিনই একমত হব না, প্রশ্নই ওঠে না।”
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এখানে নালিশের কিছু নেই। যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টা কাছেও আবার যাব।”
বুধবার রাতে গুলশানে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৃহস্পতিবার এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন।
জুলাই সনদের কয়েকটি দফা ‘অগোচরে সংশোধন’
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের সময়ে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল, পরে মুদ্রিত পুস্তকে কয়েকটি দফায় পরিবর্তন থাকার কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, “গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু সেদিন সনদের চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি।
“পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পরে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে। যেমন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরকারি বেসরকারি অফিসের টাঙানো সংক্রান্ত বিধান অনুচ্ছেদ ৪(ক) বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতিপত্র দিয়েছে।
“সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।”
‘আদেশ জারির এখতিয়ার সরকারের নেই’
মির্জা ফখরুল বলেন, ঐক্যমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠিতে বলেছে, জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলোকে দুটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের এবং আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে পেশ করছে।
“এতে বলা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার জুলাই সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে।
“সরকারের এরকম আদেশ জারি করার এখতিয়ার নাই। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে আদেশ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। সেটি জারি করা এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।”
দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাবের বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “বিকল্প প্রস্তাব-এক এ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটের উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসিল-১ বর্ণিত ৪৮টি দফার (জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলি) উপরে গণভোট হবে।
“উক্ত দফাসমূহের বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত, ভিন্নমত, নোট অফ ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐক্যমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলক জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
ফখরুল বলেন, “তাহলে এটাই প্রতিমান হয়, দীর্ঘ এক বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা।”
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐক্যমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।”
সংবিধান সংস্কার পরিষদ ‘আলোচনাতেই ছিল না’
মির্জা ফখরুল বলেন, সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে এবং তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে অভিহিত হবে।
“এখানে প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল না, আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না।”
‘গণহত্যার বিচার চাই দ্রুত’
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “বিচারের ব্যাপারে আমরা খুব সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে গণহত্যাকারীদের, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এবং অন্যান্য বিভাগের যারা সরকারি কর্মকর্তা, যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার হতে হবে এবং দ্রুত বিচার হতে হবে।
“নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। ২০২৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা যে কমিটমেন্ট করেছেন জাতির সামনে, আমরা সেটায় আস্থা রেখেছি এবং সেই হিসেবে আমরা আমাদের নির্বাচনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।