নকিব সিরাজুল হক, বাগেরহাট : বাগেরহাট জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র প্রধান ভরসাস্থল ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল। তবে এই হাসপাতালের অত্যাধুনিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি মাসের পর মাস অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকাসহ ১০ শয্যার ইনটেনসিভ কেয়ারইউনিট (আইসিইউ) জনবল সংকটে এক বছর ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। একারণে জেলার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
সরজমিনে বাগেরহাট ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখাগেছে, হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের এক কোনে ধুলো জমে পড়ে আছে ৩৮ লাখ ২৮ হাজার টাকার অধিক মূল্যের একটি অটোমেটিক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর থেকে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ মেশিনটি সরবরাহ করা হলেও আজও তা চালু হয়নি। রক্ত ও হরমোনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক বিষয় পরীক্ষা করা এই মেশিনটি প্রতি ঘণ্টায় ৩৬০টি নমুনার ফলাফল দিতে সক্ষম হলেও তা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজের সহযোগিতা না পাওয়া এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একাধিক বার চিঠি পাঠিয়েও সাড়া না পাওয়ায় মেশিনটি চালু করতে না পারায় এখনও বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ মো. হাসনুজ্জামান রাসু বলেন, ইনস্টলেশন করতে না পারায় দুই বছর আট মাস ধরে মেশিনটি ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। এটি চাল ুনা থাকায় ৪০ থেকে ৪৫ ধরনের পরীক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বাগেরহাটবাসী। এই হাসপাতালটিতে প্রতি মাসে ৬ হাজারের বেশি রোগী প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করাতে আসেন । কিন্তু আমরা উন্নত সেবা দিতে পারছিনা।
অপরদিকে, হাসপাতালে ৭ম তলায় অবস্থিত ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটটি জনবল না থাকায় এক বছর ধরে বন্ধ। সেখানে রয়েছে আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর, হার্ট মনিটর, ইনফিউশন পাম্প, ডিফিব্রিলেটর, রক্তের গ্যাসবিশ্লেষক, অক্সিজেন থেরাপি মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং উচ্চক্ষমতার রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন আধুনিক সরঞ্জাম। পাশাপাশি রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ, চিকিৎসক ও সেবিকাদের বিশ্রামকক্ষও। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় পুরো ইউনিটটি অচল হয়ে পড়ে রয়েছে এক বছর ধরে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনা মহামারির সময় ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল তিন শয্যার মাধ্যমে বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে আইসিইউ সেবা শুরু হয়। পরবর্তীতে আরও সাতটি শয্যা যোগ করে ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর মোট ১০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ইউনিট উদ্বোধন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউনিটটি সচল ছিল। প্রকল্প শেষ হতেই জনবল প্রত্যাহার করার পর থেকেই বন্ধ রয়েছে আইসিইউ।
হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের ইনচার্জ লিপি খানম বলেন, চালু অবস্থায় অনেক মুমূর্ষু রোগী এখানে সেবা পেয়েছেন, জীবন ফিরে পেয়েছেন। এখন জনবল না থাকায় রোগীদের বাধ্য হয়ে খুলনা ও ঢাকায় রেফার করতে হচ্ছে। এতে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবায় সময় ও ব্যয় দুই-ই বাড়ছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হলে যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বাগেরহাট ব্লাড ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম যাদু বলেন, প্রায় ২০ লাখ মানুষের এই জেলায় আইসিইউ বন্ধ থাকায় মুমূর্ষ রোগীদের চিকিৎসা দিতে বড় শহরে নিতে হচ্ছে। পথে অনেক রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে। কোটি টাকার সরঞ্জাম ফেলে রাখলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দ্রুত আইসিইউ চালুর জন্য কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাই।
বাগেরহাট রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শেথ মাহাবুবুর রহমান টুটুল বলেন, বাগেরহাট একটি অবহেলিত জেলা। এখানে ১০ শয্যার আইসিইউ এক বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে। ভেন্টিলেটর, মনিটর, ডিফিব্রিলেটর, রক্ত বিশ্লেষকযন্ত্রসহ কোটি টাকার সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করার জন্য অটোমেটিক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিনটিও চাল ুহয়নি। এতে সাধারণ মানুষের ভোগাšি ত্মচরমে পৌঁছেছে। আমরা অবিলম্বে এসব সমস্যার সমাধান করে সেবা চালুর দাবি জানাই।
বাগেরহাট ২৫০ শয্যার জেলাহাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, ২০২৩ সালের ৭ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করার জন্য অটোমেটিক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার দেওয়া হলেও ইনস্টলেশন করতে না পারায় চালু করা সম্ভব হয়নি। করোনা কালীন একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই আইসিইউ চালু ছিল। প্রকল্প শেষ হওয়ায় ১১ মাস ধরে ইউনিটটি বন্ধ। নতুন করে আইসিইউ চালু করতে হলে ৩ জন কনসালট্যান্ট, ৪ জন মেডিকেল অফিসার, ১২ জন নার্স এবং ১৬ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী প্রয়োজন। সরকার জনবল দিলে দ্রুত আইসিইউ চালু করা সম্ভব। এছাড়া জেলা ২৫০ বেড হাসপাতালে ৯৯টি পদের বিপরীতে মাত্র ২৬ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। জনবল ঘাটতি ও অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির কারণে বাগেরহাট জেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।