দেশবাসীর অভূতপূর্ব সাড়া না পেলে পদ্মা সেতু হতো না : প্রধানমন্ত্রী

এখন সময়: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল , ২০২৪, ১০:৩৯:২৮ পিএম

স্পন্দন ডেস্ক : পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ক্ষণে উৎসবের আনন্দ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশবাসীর ‘অভূতপূর্ব’ সমর্থনেই স্বপ্ন সফল হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুরের পল্লী জনপদ এবং কোটালীপাড়ার ‘বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বাপার্ড) উদ্বোধন করে পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা বলেন তিনি।
আসছে ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি সবাইকে অনুরোধ করব, সবাই কিন্তু ধৈর্য ধরেৃ কোনো রকম গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা বা কে আগে গেল, পরে গেলৃ এই সব করবেন না। অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সেইদিকে লক্ষ্য রেখে সবাই করবেন।
“এবং উৎসবটা শুধু পদ্মার পাড়েই হবে না, সারা বাংলাদেশে এই উৎসবটা করবেন। আমি চাচ্ছি বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় জেলায় উৎসব হোক। কারণ এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল।”
পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক চুক্তি করলেও পরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে তা আটকে দেয়, যদিও সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ আর মেলেনি। 
দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় নির্মিত এ সেতুতে এখন যান চলাচাল শুরুর অপেক্ষায় পুরো দেশ। 
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেওয়ার পর দেশবাসী যে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, সেজন্য অনুষ্ঠানে দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান শেখ হাসিনা। 
তিনি বলেন, “এভাবে মানুষের যে অভূতপূর্ব সাড়া, সেটাই আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। এটাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছিল। কারণ মানুষের শক্তিতেই আমি বিশ্বাস করি। আজকে এই পদ্মা সেতু আমরা আমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করতে পেরেছি। এত বাঁধা বিঘœ অতিক্রম করে।
“কারণ এই পদ্মা সেতু নিয়ে কত কথা, কত অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কানাডার কোর্ট মামলায় রায় দিয়েছে যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে সমস্ত অভিযোগ এনেছে সব ভুয়া, মিথ্যা। দুর্নীতির কোনো অভিযোগ এখানে টেকে নাই। আমরা আমাদের পক্ষে রায় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
সব বাধা পেরিয়ে সেতু প্রকল্প সফল হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই সেতু নির্মাণের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, সবাইকে ধন্যবাদ জানাই, আর আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আমার দেশবাসীকে। সেই সময় দেশবাসীর থেকে এমন অভূতপূর্ব সাড়া যদি আমি না পেতাম, তাহলে এটা আমি করতে পারতাম না।”
‘বেঈমানী’
পদ্মা সেতু গড়তে গিয়ে দুই রকম প্রতিবন্ধতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল- সে কথা প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
“বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদী আমাজান এবং তারপরে হচ্ছে পদ্মা। এখানে যে আমরা একটা সেতু করতে পারি এটা অনেকেরই ধারণা ছিল না। তার উপর এই সেতুটা হচ্ছে দ্বিতল সেতু। নিচ দিয়ে ট্রেন যাবে উপর দিয়ে গাড়ি যাবে এটাও একটা কঠিন কাজ।”
প্রকৃতির চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ষড়যন্ত্রও যে মোকাবেলা করতে হয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিযে তিনি বলেন, “এই সেতু করতে গিয়ে সেখানে আমাদের উপর একটা মিথ্যা অভিযোগ, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এসেছিল। যেটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম। আমরা এখানে দুর্নীতি করতে বসিনি। নিজের ভাগ্য গড়তে বসিনি। দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে এসেছি, দেশের উন্নয়ন করতে এসেছি।”
সে সময় বিশ্ব ব্যাংকের ওই আচরণের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, “সেখানে আমাদের দেশেরই একজন, যে আমাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছে, সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা আমার কাছ থেকে নিয়েছে। তারই বেঈমানীর কারণে এই পদ্মা সেতুর টাকাটা বন্ধ হয়ে যায়।
“কারণ একজন ব্যক্তি একটা ব্যাংকে এমডির পদৃ আমাদের তো প্রায় ৫২/৫৩টা ব্যাংক আছে। প্রত্যেক ব্যাংকেই তো একজন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আছে। কতজন পারে বিদেশে টাকা পাঠাতে অথবা কাউকে লক্ষ লক্ষ ডলার ডোনেশন দিতে বা বিদেশ ঘুরে বেড়াতে? কে পারে?”
সরকারের তরফ থেকে ইউনূসকে কী ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তারও কিছু বিবরণ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
“গ্রামীণ ফোন, এই ব্যবসাটা আমার আমলে আমি তাকে দিয়েছিলাম এবং তাকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক যখন একেবারে বসে যাচ্ছিল, তখন সেই গ্রামীণ ব্যাংক চালু রাখার জন্যৃ ৯৮ সাল আমাদের জন্য খুবৃ তখন বিশাল বন্যা ছিল, সেই অবস্থায় আমাদের রিজার্ভ খুবই কম। সবদিক থেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ইয়ে ছিল।
“অর্থনৈতিক মন্দা, তার উপর দীর্ঘ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সেই অবস্থায়ও ওই ব্যাংকটা যাতে চালু রাখতে পারে প্রথমে ১০০ কোটি, তারপরে ২০০ কোটি এবং তারপরে আরো ১০০ কোটি- এই ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকটা চালু রাখার সুযোগ করে দিই।”
শেখ হাসিনা বলেন, “গ্রামীণ ফোনের ব্যবসাটা দিয়েছিলাম যে ফোনের লভ্যাংশটা গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে। জীবনে এক পয়সা চাইনি। শ্রমিকদের পাওনা টাকাটাই দেয় না, তো আর কী দেবে? এটা হচ্ছে আমার দেশের নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস।
তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ওই এমডির পদটা ছাড়বেন না। যদিও আইন আছে ৬০ বছর। তার তখন ৭০ পার হয়ে গেছে। ১০ বছর তিনি বেআইনিভাবে এমডি থেকেছেন, আর তারপর আরো থাকবেন।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের তরফ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, ইউনূস উপদেষ্টা হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকে থাকতে পারেন, এমডি পদে আর নয়।
“সেটাও তিনি মানেন নাই। সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। আর মামলায় যথাযথভাবে হেরেও গিয়েছিলেন। কারণ কোর্ট আর যাই পারুক, তার বয়স তো ১০ বছর কমাতে পারে নাই। যদি কমাতে পারত, হয়ত কমিয়ে দিত, এটা আমি জানি। কিন্তু কমাতে পারেননি, হেরেও গিয়েছিল “
যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ইউনূসের সখ্যের প্রসঙ্গ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি তদবির করে এই ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে দিয়ে... হিলারি ক্লিনটন তার বন্ধু ছিল, সে ছিল আমেরিকার পরররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে তিনি (ইউনূস) মোটা অংকের চাঁদাও দিয়েছিলেন, অনুদান দিয়েছিলেন।
“জানি না এত টাকা সে কোথা থেকে পেল। কিন্তু সেটাও দিয়েছিল। কাজেই সেই আমেরিকান সরকারকে ধরে এই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমার পদ্মার টাকা বন্ধ করে দেয়। এবং আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় কানাডা কোর্টে।”
সে সময় বিশ্ব ব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, দুর্নীতির যে অভিযোগ তারা তুলেছে, তার প্রমাণ তাদের দিতে হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমি এমনিতে মেনে নেব না। প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণ দিতে পারে নাই। তখন আমি বলেছিলাম, টাকা লাগবে না। আমরা নিজের টাকায় করব।”
সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের তৃপ্তি প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আল্লাহর রহমতে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়ে গেছে। যে দক্ষিণ অঞ্চল সারা জীবন অবহেলিত ছিল আর অবহেলিত থাকবে না। কারণ এই যোগাযোগ ব্যবস্থা একটা জায়গায় যদি হয়, তাহলে সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই উন্নতি হয়।
“দারিদ্র্য আমাদের নিত্যসঙ্গী। আল্লাহর রহমতে আর সেটা থাকবে না।”