Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

যশোরে ঢাকার ‘নীলক্ষেত’ বুকশেলফ ভর্তি মণিমুক্তো

এখন সময়: শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর , ২০২৪, ০৫:০৭:০৯ পিএম

 

সালমান হাসান রাজিব: প্রত্যেকটি তাকের একেকটি বিচিত্র ও বহুমুখী জ্ঞানের ভাণ্ডার ভর্তি। শতশত সহস্র বই শেলফ জুড়ে। কোনো কোনোটি প্রায় একদমই আনকোরা নতুন। আবার কিছু কিছু বইয়ের বাঁধাই বেশ ভালো। কিন্তু ‘কাভার পেজ’ উঠে গেছে। দীর্ঘদিন এখানে সেখানে পড়ে থাকায় অনেক বইয়ের ওপরে ধুলোর পুরু স্তর জমেছে। কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে নিলেই একদম ঝকঝকে তকতকে। কিছু বইয়ের অবস্থা আবার জরাজীর্ণ। সংগ্রহে আছে অনেক পুরাতন দুর্লভ সব ম্যাগাজিন।

বিপুল পরিমাণ সৃজনশীল ও মননশীল বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাকে সাজিয়ে ও মেঝেতে লাট মেরে ফেলে। রাজধানী ঢাকার আরেক ‘নীলক্ষেত’ যেন যশোর শহরের শিল্পকলা একাডেমি সড়কের (আব্দুল হালিম রোড) পুরাতন বইবাজার। ‘পুরাতন লাইব্রেরি’ বা পুরোনো বইয়ের দোকান নামে স্থানটি সমধিক পরিচিত।

এখানকার এক সময়ের ব্যবসায় ছিল মূলত সৃজনশীল ও শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের তাত্ত্বিক ও জ্ঞানমূলক বইয়ের বেচাবিক্রি। কিন্তু দিনকে দিন পাঠক ও জ্ঞানচর্চা কমে যাওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা গাইড বইয়ের ব্যবসায় ঝুঁকেছেন। তবে সেটির অবস্থাও ভালো না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বইয়ের এই বাজারটি জ্ঞানপিপাসু মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আসছে। দুই ধরণের ক্রেতার সমাগম হয় এখানে। সুলভ দামে গাইড বইয়ের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

গাইড বই ছাড়াও গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধসহ সৃজনশীল বহুমুখী বইয়ের সমাহার রয়েছে এখনকার কুষ্টিয়া লাইব্রেরিতে। অন্যান্য দোকানগুলোর তুলনায় এই দোকানটিতে জ্ঞানমূলক বইয়ের সংগ্রহ সবচেয়ে বেশি। দোকানটির বয়স ২২ বছর। একই নামে এখন দুটি দোকান রয়েছে।

লাইব্রেরি দুটির স্বত্বাধিকারী আরিফুল ইসলাম জানান, মোহাম্মদ লিটন হোসেন নামে টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি প্রথম এখানে পুরাতন বই বিক্রির কারবার শুরু করেন। দীর্ঘদিন এখানে ব্যবসা করার পর নিজের এলাকায় ফিরে গেছেন। ওই ব্যক্তির হাত ধরে এখানে পুরাতন বইয়ের লাইব্রেরির পত্তন হয়।

পুরাতন বই কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়; এমন প্রশ্নে বলেন, ঢাকাসহ স্থানীয় বিভিন্ন উৎস থেকে বই সংগ্রহ করেন। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তাদের বই এখানে বিক্রি করেন দেন। পরবর্তীতে অন্যরা সেটি কিনে পড়েন। এভাবে হাত বদল চলতে থাকে।

মফিজ বুক ডিপোর স্বত্বাধিকারী মফিজুল ইসলাম জানান, ২০০২ সালে পুরাতন বইয়ের জগতে প্রবেশ করেন। তখন অন্যের একটি বইয়ের দোকানের কর্মী ছিলেন। ৮ বছর সেখানে কাজ করার পর নিজেই দোকান দিয়েছেন।

আলাপচারিতায় মফিজ জানান, প্রথম দিকে এখানে যখন দোকান দিই তখন গল্প ও উপন্যাসের বইয়ের প্রচুর পরিমাণ চাহিদা ছিল। সে সময় মাধ্যমিক পর্যায়ের গাইড বই প্রচুর বিক্রি হতো। কিন্তু এখন সৃজনশীল ও গাইড বই দুটোরই চাহিদা কমে গেছে।

মফিজ বলেন, এখানে কলেজ বিশ^বিদ্যালয় ছাড়াও মেডিকেলেরও বই পাওয়া যায়। কবি, সাহিত্যি, লেখক ও গবেষকরা এখান থেকে গল্প, উপন্যাস ও কবিতাসহ জ্ঞানমূলক বিভিন্ন বই কিনে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, এক সময় বিভিন্ন লেখকের গল্প সমগ্র প্রচুর বিক্রি করতাম। রবীন্দ্র, নজরুলম বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করসহ বিভিন্ন নামকরা লেখকের গল্প সমগ্র ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে এসে বিক্রি করতাম। তখন বইয়ের দাম ছিল অনেক কম। একেক খন্ড গল্প সমগ্র ৩০ টাকায় বিক্রি করতাম। সেসময় দিনে কম করে হলে ১০০০ টাকার বই বিক্রি হতো। কিন্তু এখনকার বইয়ের দাম অনেক বেশি। পৃষ্ঠারও মান ও বাঁধাই ভালো না। এ ছাড়া মানুষজন এখন বেশি মাত্রায় ফেসবুক ও ইউটিউবে ডুবে গেছে। এতে বই বিক্রি কমে গেছে।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে পুরাতন বইয়ের ব্যবসায় ভালো যাচ্ছে না। বছর বছর সিলেবাস ও কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে এই ব্যবসায়ে ভাটা পড়েছে।

সরেজমিন যশোর শহরের পুাতন বইয়ের এই লাইব্রেরি ঘুরে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি ও বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার নানান ম্যাগাজিন। সানন্দা, দেশ পত্রিকাসহ বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রের ঈদ সংখ্যা ও অন্যান্য পুরনো ম্যাগাজিনের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এ ছাড়া বাঙলা সাহিত্যের ক্লাসিক পর্যায়ের সব ধরণের বই এখানে পাওয়া যায়। ইশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্র, নজরুল, বিভূতি ভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিকসহ সব বিখ্যাত লেখকের বই এখানে রয়েছে। এ ছাড়াও মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং, লাকা, দেরিদা, মিশেল ফুকো, নোয়াম চমস্কিসহ আরো অন্যান্য অনেক দার্শনিকদের বই এখানে কম দামে পাওয়া যায়। বিশ^ সাহিত্যের অনেক ভালো মানের অনুবাদের বই খুঁজলে এখানে প্রায়শই পাওয়া যায় বলে জানান হ্যালো স্পিকার নামে ইংরেজি ভাষা শেখানোর একটি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এরফানুল হক পলাশ।

তিনি জানান, পুরাতন বইয়ের এই দোকগুলোর একেকটি জ্ঞানভান্ডার। এখানকার শেলফগুলো মননশীল সব বইয়ের রত্ন ভান্ডার। অনেক দুর্লভ বই এখানে পাওয়া যায়। রিপ্রিন্ট হবার আর সম্ভাবনা নেই; সেসব বইপ্রাপ্তির একমাত্র স্থান বইয়ের এই বাজারটি। খুঁজে দেখলে ‘মার্কেট আউট’ সেসব বই এখানে পাওয়া যায়।

পলাশ আরো বলেন, মুদ্রিত কপি শেষ হয়ে যাওয়া কোনো কোনো বই আবার হয়তো ‘রিপ্রিন্ট’ হতে পারে। কিন্তু ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে সেটির কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানে অনেক পুরাতন ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। সেগুলো এখন দুর্লভ।

এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ কমিশন বুক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী সেলিম রেজা। তিনি বলেন, পুরনো বইয়ের ঐতিহাসিক মূল্য, আবেগ, ও এর সাথে স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। থাকে পুরনো একটা গন্ধ। এই গন্ধে মাদকতা আছে।

তিনি বলেন, পুরনো বইয়ের দাম কম ঠিকই কিন্তু গুরুত্ব বেশি। কত জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিত ব্যক্তি আসেন, আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীরা। সারাদিন জ্ঞানী মানুষদের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদান করতেও ভালো লাগে।

তিনি আরো বলেন, বই পড়ুয়া মানুষেরা এখান থেকে কিনে নেয় দুর্লভ সব বই। অজস্র পুরনো বইয়ের ভেতরে দেখা মেলে মূল্যবান সব বইয়ের। অল্প টাকায় মূল্যবান বই কিনতে মানুষ এই এলাকায় শুধু আসেই না, বিক্রেতাদের সঙ্গেও সখ্য হয়ে যায়। ভালো বই পেলে তারা রেখে দেন নির্ধারিত ক্রেতাদের জন্য। এখানে অধিকাংশ বিক্রেতা জানেন কোন পাঠক কী বই পছন্দ করে। তাদের জন্য সেসব বই রেখে দেন বই।

পুরাতন লাইব্রেরির একেটটি দোকানে ঢু মারলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভিন্ন এক জগতের চিত্র। যশোর কোর্ট পেরিয়ে পশ্চিমুখে পৌর পার্কের দিকে এগোলে পুরাতন এই বইয়ের বাজার। প্রতিটি দোকানে পরিপাটি করে করে সাজানো সব পুরনো বই। এসব দোকানে পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, গবেষণা, প্রবন্ধসহ বাংলা ও ইংরেজি ভাষার হাজার রকমের বই।

পুরাতন বই ব্যবসায়ীরা কোথা থেকে সংগ্রহ করেন এমন প্রশ্নে দু’একজন তথ্য দিলেও বাকিরা এড়িয়ে গেছেন। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার নীলক্ষেত ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল ছাড়াও যশোর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘ভাঙারি’ মালামালের দোকানগুলোও পুরাতস বইয়ের বড় একটি উৎসস্থল। ‘ভাঙারি’ ব্যবসায়ীরা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে পুরোনো খবরের কাগজ ও বইপত্রিকা এবং ম্যাগাজিন কেনেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যারা পুরোনো সংবাদপত্র ও কাগজ কেনেন তারাও এই পুরনো লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ করেন। তাদের কাছ থেকে পিস হিসেবে ও কেজি দরে কেনা পুরাতন বই এবং ম্যাগাজিন এই লাইব্রেরিগুলোয় বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে একেকটি বই ও ম্যাগাজিনের দাম মুদ্রিত মূল্যের অর্ধেক বা তার চেয়েও বেশি নেয়া হয়। কোনো কোনো বইয়ের দাম মুদ্রিত মূলের শতকরা ৪০ ভাগ নেয়া হয়।

এখান থেকে নিয়মিত বই কেনেন মাঈনুদ্দিন রিংকু। আলাপচারিতায় তিনি জানান, পুরাতন এই বই বাজারে অনেক কম দামে আগে বই পাওয়া যেতো। কিন্তু দিনকে দিন দাম বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু বইয়ের দাম প্রায় নতুনের কাছাকাছি রাখা হয়।

আরেক ক্রেতা যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম আশরাফ জানান, পুরাতন লাইব্রেরি থেকে পছন্দের লেখকের গল্প, উপন্যাস ও সাহিত্যের বই কেনেন। পড়া হয়ে গেলে সেগুলোর কিছু কিছু বিক্রি করে দিয়ে আবার নতুন বই কেনেন।

জেলা শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন এই সড়কে প্রথম দিকে পুরাতন বইয়ের দোকান গড়ে তোলা ব্যক্তিদের একজন ভাই ভাই লাইব্রেরির সত্ত্বাধিকারী মো. আব্দুল্লাহ। তার নিজের কয়েক ভাই ছাড়াও জ্ঞাতি সম্পর্কের আরো বেশ কয়েকজন এখানে পুরাতন বইয়ের কারবার করছেন।

আলাপচারিতায় মো. আব্দুল্লাহ জানান, ১৯৮০ সালে যশোর শহরে পুরাতন বইয়ের লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। মোমিননগরের ভেতর ইউনুস আলী নামে একজন বরিশাল লাইব্রেরি নামে পুরাতন বইয়ের দোকান গড়ে তোলেন।

তিনি বলেন, গরীবশাহ্ সড়কের শেষ মাথায় লিটন হোসেন নামে টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি ৯০’র দশকে পুরাতন বইয়ে দোকান দেন। আর তিনি নিজে ১৯৯৬ সালে এখনকার জেলা শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন সড়কটিতে পুরাতন বইয়ের লাইব্রেরি গড়েন। এখানকার শুরুর দিককার আরেকজন আদর্শ লাইব্রেরির খলিলুর রহমান।

আব্দুল্লাহ আরো জানান, বর্তমানে এখানে বইয়ের দোকানের সংখ্যা ২৯টি। কিন্তু দিনকে দিন ব্যবসায়ের অবস্থার যেরকম অবনতি; তাতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমে যাবে। বছর বছর সিলেবাস পরিবর্তন ও নতুন নতুন নিয়ম প্রবর্তণের কারণে পুরাতন বইয়ের চাহিদা কমে গেছে।

এখানে যেসব বই পাওয়া যায়-কোথা থেকে সংগ্রহ হয়; এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ঢাকার নীলক্ষেত, বাংলাবাজার, রাজশাহী ও চট্টগামসহ দেশের বিভিন্ন প্রাপ্ত থেকে পুরাতন বই সংগ্রহ করা হয়।

পুরাতন এই বইয়ের বাজারে সৃজনশীল বইয়ের সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ রয়েছে সততা বুক হাউসে। প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী সমিন হোসেন বলেন, বই পুরনো হয়, পুরনো হয় না জ্ঞান। যারা সমঝদার; তারা এখান থেকে জ্ঞানের বহুমুখী শাখার বই কিনে নিয়ে যান।

Ad for sale 100 x 870 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
Ad for sale 225 x 270 Position (4)
Position (4)