আবদুল কাদের: করোনার সময় থেকে যশোরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং মোটরপার্টস ব্যবসায়ে মন্দাভাব চলছে। সর্বশেষ এসব ব্যবসায়ীদের ধাক্কা দিয়েছে গত ৫ আগস্টে সরকার পতন হবার পর। সরকার পতনের পর কমপক্ষে ১৫ দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখেন সব পর্যায়ের ব্যবসায়ী। এখন তাদের দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে ব্যাংক ঋণের কিস্তি। আবার নতুন করেও ব্যবসায়ীরা কোনো ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। এতে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা।
যশোর বিসিক শিল্প নগরীতে গড়ে ওঠা মদিনা মেটালের স্বত্ত্বাধিকারী ফারুক হোসেন জানান, গত ৪-৫ বছর ধরে আমাদের ব্যবসায়ে মন্দাভাব বিরাজ করছে। ব্যাংকের সুদ হার বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ সেই অনুপাতে বিক্রি নেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে, সব বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে জমা রাখলে মনে হয় ভালো হতো।
এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার মালিক আকতার হোসেন বলেন, আমরা গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে থাকি। গত কয়েক বছর ধরে মালের কোনো চাহিদা নেই। ব্যাংকের সুদহার ১৩-১৪ শতাংশ দিতে হচ্ছে। এভাবে চললে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।
মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের রাজধানী বলা হয় যশোর জেলাকে। এখানকার আমদানিকারকরা পার্টস আমদানি করে সারা দেশে বিক্রি করে থাকেন। প্রায় ২ হাজার দোকানীর ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে পার্টস খাতে। করোনাকালে এসব ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ ছিলেন চরম আর্থিক ঝুঁকিতে। এখন ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারার কারণে ব্যবসায় তলানীতে ঠেকেছে। আবার ভারতীয় কোম্পানির ডিলারশিপ বাতিলের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। পার্টস আমদানি করতে না পারলে তারা ঢাকার ব্যবসায়ীদের ডিলারশিপ দিয়ে দিতে পারে। বর্তমানে ব্যবসায় এক প্রকার বন্ধ থাকায় কর্মচারীদের বেতন দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
যশোর-খুলনা সড়কের ফারিয়া মোর্টরসের স্বত্ত্বাধিকারী ও আমদানিকারক রোজোয়ান আহমদ মুরাদ জানান, করোনায় গত ২ বছর ব্যবসায় হয়নি। কোনো রকমে টিকে আছি। পুঁজি ভেঙে কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি। এখন এলসি করতে না পারার কারণে পণ্য আনতে পারছি না। আবার ব্যাংক কোনো ঋণও দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছি না।
শহরের আরএন রোডের নির্জন এন্টার প্রাইজের মালিক মো. রানা বলেন, আমি মূলত থ্রি-হুইলার, ফোর হুইলার পার্টস আমদানি করে থাকি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা এসব পার্টস নিয়ে যান। কিন্তু গত ২ বছর ধরে এলসি বন্ধ থাকার কারণে মালামাল আনতে পারছি না। ব্যাংকের ঋণের কিস্তি, দোকান ভাড়া-বাড়ি ভাড়া, কর্মচাীরর বেতনসহ সংসার ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে আর এক দুই মাস চললে ব্যবসায় ছেড়ে দিতে হতে পারে।
বাংলাদেশ মোটরপার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর শাখার সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু জানান, যশোরে প্রায় ২ হাজার মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। যার বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণ। ২ হাজার দোকানে প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী রয়েছে। যাদের বেতন ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নতুন করে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। যেকারণে তারা ব্যবসাও করতে পারছেন না।
বেনাপোল কাস্টম অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে বেনাপোল দিয়ে মোটরপার্টস আমদানি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার। বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, গাড়ির চেচিস ও মোটরপার্টস আমদানি বেশি হলে রাজস্ব আহরণ বাড়ে। কম শুল্কযুক্ত পনণ আমদানি হলে রাজস্ব কমবে এটা স্বাভাবিক। গত ২ বছর ধরে মোটরপার্টস আমদানি হচ্ছেনা বললে চলে।
সারাদেশে অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের পণ্য। যার ফলে যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। পদ্মাসেতু চালু ও অনলাইন প্লাটফরম তৈরির ফলে প্রায় ৩০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছিল। কিন্তু গত গেল জুলাই আগস্ট মাসে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবার কারণে অনলাইনে ব্যবসায় বন্ধ হয়ে পড়ে।
যশোরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে কৃষিজ মেশিন, ফুড মেশিন, ফাউন্ড্রি, ছোট ছোট কারখানার মেশিন বিভিন্ন রকমের মটর পার্টস, সেফটি সিকিউরিটি পার্টস, রিপেয়ারিং সার্ভিস ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। কারখানাতে ঢালাই লোহা ও স্প্রিং লোহার সাহায্যে এসব মেশিন, মেশিনারিজ ও পার্টস তৈরি হচ্ছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব পণ্য বড় প্রতিষ্ঠান থেকে পাইকারি রেটে কিনে খুচরায় বিক্রি করছে। যশোর অঞ্চলে প্রায় ৩শ’টি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির সাথে সম্পৃক্ত।
এ ব্যাপারে অথৈ লিমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বত্তাধিকারী আবিদ হাসান বলেন, এর আগে তিনি প্রতি মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতেন। কিন্তু জুলাই ও আগস্টে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে আমাদের ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে।
রুপালি ব্যাংক যশোরের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, মূলত ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। যেকারণে ব্যাংকগুলোও তাদের ব্যবসায় ঠিকমত করতে পারছে না।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, করোনার কারণে সব ব্যবসায় ধস নামে। বেশি নেমেছে গাড়ির ব্যবসায়ে। যশোর শহরের আরএন রোড মোটরপার্টস ও মোটর সাইকলের পার্টসজোন হিসেবে সবস্থানে পরিচিত। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এলসি বন্ধ থাকার কারণে খাদ্যপণ্য ছাড়া সব আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যবসায়ীরা খেলাপি হচ্ছে, অন্যদিকে এখাতে কর্মসংস্থান নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আবার নতুন করে ব্যাংক ঋণ মিলছে না। মিললেও উচ্চ সুদ দিতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না।