স্পন্দন ডেস্ক : জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘নবজন্ম হল’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, “এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম। এটা শুধু জাতির জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য একটা বড় রকমের উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
শুক্রবার বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষরের এই আনুষ্ঠানিতা সারা হয়।
রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে যেসব রাজনৈতিক দল ও জোট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ সংলাপ পর্বে অংশ নিয়েছিল, তারমধ্যে ২৫টি দলের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা এবং ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরাও এ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিলে স্বাক্ষর করেন।
সনদে স্বাক্ষরের পর প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “আল্লাহর রহমতে আজকে আমরা সফল করতে পারলাম। এ যে মহান দিবস এবং তার মধ্যে বিশেষ একটি ক্ষণ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন; সমস্ত জাতি, রাজনৈতিক নেতা একসঙ্গে হয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছে।”
রাজনৈতিক মতানৈক্যের মধ্যে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “অবাক কাণ্ড। সারাদেশ দেখল, সমস্ত রাজনৈতিক দল শুধু বসল না, চসৎকার আলাপ করল। গভীরেভাবে জ্ঞানের সঙ্গে, সৌহার্দ্যের সঙ্গে আলোচনা করল, না দেখলে বিশ্বাস হত না।
“সরাসরি সম্প্রচারে সবাই দেখেছেন। সবাই শুনতে পেয়েছে, মনে মনে অংশ নিয়েছে সবাই।ৃসারা জাতিকে এ আলোচনায় শরিক করেছেন।”
ক্রমে ক্রমে দলগুলোর ঐকমত্যে আসার কথা তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ‘অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য’ রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ও সদস্যদের ধন্যবাদ দেন।
তার ভাষায়, “তারা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে, তাদের নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে।”
চব্বিশের অভ্যুত্থান বাংলাদেশে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা এবং সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা কাজে লাগাতেই গতবছরের শেষে এই সনদ করার দাবি তুলেছিলেন জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা।
তাদের গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঐকমত্যের সংলাপে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি ‘স্পষ্ট’ না হওয়ার যুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে দলটি।
এছাড়া ইতিহাস ‘সঠিকভাবে না আসা’ এবং সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে আপত্তির কারণে বাম ধারার চারটি দল সনদে সই না করার ঘোষণা দিয়েছিল। দলগুলো হল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
সংলাপে থাকা বাকি ২৫টি দল এ সনদে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে ঐকমত্যের আলোচনায় গৃহীত সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করল।
ইউনূস বলেন, “আজকে এ দিনটি যে পেলাম, এটা মহান দিন। এটার কথা চিন্তা করলে গা শিউরে উঠে। সেটা শুধু জাতির জন্য জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য একটা বড় রকমের উদাহরণ হয়ে থাকবে। বহু জায়গায় পাঠ্যপুস্তকে থাকবে এটা।”
এই ‘উদাহরণ’ সৃষ্টি করায় রাজনীতিবিদদের ‘মোবারকবাদ’ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ সুযোগ যারা দিল, যার কারণে হল, তাদের কথা স্মরণ করি, গণ অভ্যুত্থানের নায়কদের কথা স্মরণ করি। জাতি তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ।”
এ সনদের মাধ্যমে দেশ পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আজ আমরা যে কাজটা করলাম, সবাই মিলে স্বাক্ষর করলাম। সেটা দিয়ে বাংলাদেশ পরিবর্তন হবে। এ পরিবর্তন সম্ভব হল ওই গণভ্যুত্থানের কারণে। এটা হল দ্বিতীয় অংশ। সেটা করেছিল বলেই আমরা এ সুযোগ পেলাম।
“পুরনো কথা পাল্টে ফেলে নতুন কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে, সংবিধানের পরিবর্তনের মধ্যে, সরকার চালানোর বিষয়ে নিয়ে এলাম।”
তিনি বলেন, “অনেক বিষয় এসেছে এ পরিবর্তনের ভেতরে। এ পরিবর্তন এখন আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা সে পথে অগ্রসর হবে। আমাদের জন্য আজকে নবজন্ম। আমাদের নবজন্ম হল। এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম। আমরা যেন সঠিকভাবে যেতে পারি, এটা থেকে যেন বিচ্যুত না হই।”
একমত হয়ে সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনা করে সামনের দিকে এগোনোর আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “এ পরিবর্তনের জন্য জীবন দিয়েছে দেশের আনাচে কানাচে, তরুণরাই বাংলাদেশকে গড়বে, এ দেশের নেতৃত্ব দেবে, পথ দেখাবে। এ দেশ তরুণদের।”
দেশের অর্ধেক মানুষের বয়স যে ২৭ বছরের নিচে, সে কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটা দেশের সম্পদ। সারা দুনিয়ায় তরুণদের অভাব, তারা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীকে পরিবর্তন করার সুযোগ তাদের এসেছে।”
এ সনদের মাধ্যমে ‘বড় কাজ’ হল মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম, যেখানে আইন কানুন ছিল না। এখন আমরা সভ্যতায় এলাম। এমন সভ্যতা গড়ে তুলব মানুষে বিস্ময়ের চোখে দেখবে।”
সমাজ গঠন করতে পারলে দেশের ভবিষ্যত ‘চমৎকার’ বলে বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “অন্য সব কাজে একমত হয়ে চললে অনন্য দেশে পরিণত হবে।ৃএ সনদ তর্ক বিতর্কের অবসান করবে। আমরা নিয়ম মাফিক চলার জন্য তৈরি হব। অনেক আলোচনার মধ্য দিয়ে আজ সই করলাম, এটা আমাদের পথ দেখিয়ে দেবে। এ পথে চললে সম্পদের ব্যবহার করতে পারব।”
বঙ্গোপসাগরের সম্পদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরিবর্তন আনতে পারে মন্তব্য করে ইউনূস বলেন, “মাতারবাড়ি, কক্সবাজার, মহেশখালী সব কিছু মিলিয়ে একযোগে বন্দর উন্নয়ন করলে পুরো এলাকা নতুন সিঙ্গাপুরে পরিবর্তন হবে। সব দেশের মানুষ এখানে আসবে।”
তিনি বলেন, “আজ যে সনদ সই করল, সেটা বহু দেশ শিখতে আসবে। আমরা একটা মহান জাতি, সেটা অনুভব করতে হবে।”
ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আজ যে সুর বাজালাম, সেই সুর নিয়ে নির্বাচনের দিকে যাব, ঐক্যের সুর। ঐক্যের সুর নিয়ে নির্বাচনের দিকে যাব আমরা। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, এ ঐক্য যেন বজায় থাকে। রাজনীতি, নির্বাচনের ব্যাপারে আপনারা বসে সনদ করেন।”
ভবিষ্যতে নিজেরা বসে ‘সুন্দর ইতিহাস’ রচনার আহ্বান রেখে তিনি বলেন, “সেটা যেন উদাহরণ হয়, সেটা জাতির জন্য উদহারণ, বিশ্বের জন্য উদাহরণ, আমরা সে নির্বাচনটা করতে চাই। আমরা পারব। আজ সে পারার চিহ্ন আমরা এখানে রেখে গেলাম। এ চিহ্নটা ধরে আমরা পথে অগ্রসর হব।”