নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বজন, সহকর্মী আর সহযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায় নিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ। শনিবার জোহরবাদ জজকোর্ট চত্বরে জানাজা এবং গার্ড অব অনার প্রদান শেষে কারবালা কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়। গার্ড অব অনার প্রদান করেন সদর সহকারী কমিশনার (ভুমি) নুসরাত ইয়াসমিন। এ সময় তার কফিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রয়াতের স্মরণে তিনদিনের কর্মসূচি নিয়েছে প্রেসক্লাব যশোর। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় দোয়া মাহফিল ও শোকসভার মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ হবে।
এর আগে উদীচী এবং প্রেসক্লাব যশোর প্রাঙ্গণে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে জেলার কৃত্তিমান পুরুষ রুকুনউদ্দৌলাহর মরদেহ নেয়া হয়। লাল সবুজের জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেয়া হয় বীর সেনানিকে। যশোরের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনসহ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে অর্পণ করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এর মধ্যে প্রেসক্লাব যশোর, যশোর সংবাদপত্র পরিষদ, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে), সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোর, জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন জেলা শাখা, দৈনিক স্পন্দন পরিবার, গ্রামের কাগজ পরিবার, দৈনিক লোকসমাজ, দৈনিক কল্যাণ, সমাজের কথা, বাংলার ভোর, দৈনিক রানার, যশোর জেলা বিএনপি, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, উদীচী যশোর, যশোর সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার সুন্দরবন অঞ্চল, সুরবিতান সংগীত একাডেমি, পুনশ্চ, সুরধুনী, চাঁদের হাট, স্পন্দন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, উৎকর্ষ, মাইকেল সংগীত একাডেমি, কিংশুক, তির্যক, ভবের হাট, বিবর্তন, থিয়েটার ক্যানভাস, মহিলা পরিষদ যশোর জেলার সংসদ, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বাঁচতে শেখা, উলাসী সৃজনী সংঘ, আইইডি, নাগরিক অধিকার আন্দোলন প্রমুখ। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন দোদুল, কাজী আব্দুস সবুর হেলালসহ ব্যক্তিগতভাবেই অনেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন।
জানাজাতেও অংশ নেন সর্বস্তরের বিশিষ্টজনেরা। জানাযা শুরুতেই রুকুনউদ্দৌলাহ এর অগ্রজ ও দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ্ দ্দৌলা ও মেয়ে জামাই রাকিবুল আলম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে পূর্ব নির্ধারিত ঈদগাহ ময়দান থেকে সরে জজ কোর্ট আদালত প্রাঙ্গণে গার্ড অব অনার ও জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জানাজায় অংশ নেন ও প্রেসক্লাবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিসের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা এএসএম কবীর, চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, বিএনপি নেতা গোলাম রাজা দুলু, অ্যাড.আনিসুর রহমান মুকুল, যুবদলের সদস্য সচিব আনসারুল হক রানা, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মোস্তফা আমির ফয়সাল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জিল্লুর রহমান বিটু, জেলা কমিটির সম্পাদক এস এম তসলিমুর রহমান, সিপিবির ইলাহদাদ খান, অ্যাড. আবুল হোসেন, জেলা জাসদের সহসভাপতি আহসান উল্লাহ ময়না, অ্যাড. আবুল কায়েস, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদুর রহমান, দৈনিক গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, দৈনিক স্পন্দন এর নির্বাহী সম্পাদক মাহাবুব আলম লাবলু, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন ( জেইউজে)’র সভাপতি সাজেদ রহমান, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিলন, সাবেক সভাপতি আমিনুর রহমান মামুন, সাজ্জাদ গনি খান রিমন, ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি আকরামুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক এসএম ফরহাদ, জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শেখ দিনু আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মোর্শেদ আলম, সাংস্কৃতিক জন হারুন অর রশিদ, অ্যাড মাহামুদ হাসান বুলু প্রমুখ। এদিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ মামুনুর রশিদ বর্ষীয়ান সাংবাদিক রুকুনউদৌলার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বীরমুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ্ গত ২৭ জুলাই রুটিন চেক-আপের জন্য ঢাকার ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালটিতে তিনি দেশবরেণ্য চিকিৎসক অধ্যাপক এমএ রশিদের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। এ সময় এনজিওগ্রামে তার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে তিনি যশোরে ফিরে আসেন। এরপর ১৭ আগস্ট তিনি ফের ঢাকার ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ১৯ আগস্ট তার হার্টে ৩টি রিং স্থাপন করা হয়। কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া না থাকায় ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয় এবং বিকেলে তিনি যশোরে ফিরে আসেন। কিন্তু শুক্রবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। রাতে তার মরদেহ শহরের খালধার রোডের নিজ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রয়াতের জামাতা রাকিবুল আলম জানিয়েছেন, প্রয়াত সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ্ স্মরণে আগামীকাল সোমবার বাদ আসর দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এদিন আমিনিয়া আলিয়া মাদরাসা মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মহিলাদের জন্য খালধার রোডের বাসভবনে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহর পিতা মরহুম মোকসেদ আলী। রুকুনউদ্দৌলাহ’র শৈশব-কৈশোর কেটেছে নওগাঁয়। সেখানে থাকতেন অগ্রজ আসফউদ্দৌলা’র কাছে। নওগাঁ কেডি স্কুলে পড়াকালীন বেজে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের দামামা। রাজনৈতিক সচেতন রুকুনউদ্দৌলাহ পরিবারের সাথে চলে যান ভারতে। সেখানে শিলিগুড়িতে প্রশিক্ষণ শেষে ফ্রিডমফাইটার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ধর্ম, মানবতা, সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ঢোকেননি এক মুহূর্তের জন্যেও। দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম ‘দৈনিক সংবাদ’র সাথে জড়িত পাঁচ দশক ধরে।
‘সংবাদ’ এ তার নিয়মিত কলাম ‘গ্রাম-গ্রামান্তরে’ বেশ জনপ্রিয়। তিনি চ্যানেল আই, রেডিও টুডেতে কাজ করেছেন। যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্ফুলিঙ্গ, দৈনিক ঠিকানা, দৈনিক রানার, দৈনিক কল্যাণ’-এ বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে যশোর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক যশোরের কাগজের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন।
এ পেশায় সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন বজলুর রহমান স্মৃতিপদক, আইডিই পুরষ্কার, যশোর শিল্পী গোষ্ঠী পদক ও জ্ঞানমেলা পদক।
তাঁর লেখা শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ‘গ্রাম-গ্রামান্তরে’, নবযুগ প্রকাশনী থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর’, নবরাগ প্রকাশনী থেকে ‘আমার কৈশোর আমার মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মানুষের ভাবনা মানুষের কথা’ এবং ‘ছোট ছোট কথা অচেনা মানুষ’, ‘পতাকার অক্ষত ভূমি’ নামে বই প্রকাশিত হয়েছে।